হাসান রূহী
পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার বারআনি গ্রামে একটি তাফসিরুল কোরআন মাহফিলে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মাহফিলের প্রধান অতিথি মাওলানা আজিজুল হককে বেদম প্রহার করেছে ধুলাউড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ধুলাউড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জরিফ আহমেদ মাস্টার, সেক্রেটারি রঞ্জু ফকিরসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের মত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিকে মারপিট করে কেন আহত করা হলো এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যপক তোলপাড় হলেও সরকারের কর্তা-ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন হলো, প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পেয়ে আসা সম্মানিত সেই বক্তা এমন কি বলেছিলেন যে মাহফিলে উপস্থিত শত শত মানুষের সামনে তাকে এভাবে হেনস্তা করা হলো? সামাজিক মাধ্যমে আসা প্রত্যক্ষদর্শীর খবর ও পত্রিকায় আসা তথ্য মতে, মাওলানা আজিজুল হক জিহাদী যখন আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন- ‘রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবী রাদিয়াল্লহু আনহুমা যখন কুরআন তিলাওয়াত করতেন তখন আবু জেহেলের গায়ে আগুন লেগে যেতো, তেমনিভাবে আজোও আবু জেহেলের অনুসারীরা কুরআনের আলোচনা বরদাশত করতে পারেনা।’। এসময় বক্তব্য চলাকালিন সময়েই আওয়ামী নেতা জারিফ মাস্টার তাকে জিজ্ঞাসা করেন-‘এখানেও আবু জাহেল আছে কিনা?’ বক্তব্যকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করলেও স্বাভাবিকভাবেই বক্তা বলেন- ‘থাকতেও পারে।’ একথা শোনার সাথে সাথেই বক্তার মাইক কেড়ে নিয়ে তাকে উপস্থিত শ্রোতাদের সামনেই দলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে ওই আওয়ামী নেতা। এসময় পরিকল্পিতভাবে মঞ্চের লাইটও নিভিয়ে দেয়া হয় বলে খবরে প্রকাশ।
কুরআন শুনতে আবু জেহেল ও তার দলবল বাধা দিত এটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সত্য ঘটনা। এবং এটাও সত্য যে, যে যুগে আবু জেহেল ছিল সে যুগে আবু বকরের মত জান্নাতি মানুষও ছিল। এবং একইভাবে এই সমাজে উভয় শ্রেণির মানুষই আছে। এটিও নতুন কোন বিষয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মাওলানা সাহেবের অপরাধটা কোথায়? কেন তাকে এভাবে নির্মমভাবে মাহফিলের মঞ্চেই পেটানো হলো? বক্তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রশ্ন করাটাও আদৌ কোন ধরণের ভদ্রতার মধ্যে পড়ে কিনা?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য মহাবীর হযরত আমির হামযা (রা:) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংক্ষেপে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি। হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব রসূল (স:) এর আপন চাচা। কিন্তু আপন চাচা হলেও তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। একদিন রসূলে আকরাম (স:) কাবার চত্ত্বরে মানুষকে সতর্ক করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তাদেরকে দুনিয়ার জীবন ও এর শেষ পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জানাচ্ছিলেন। এসময় দূর থেকে দেখে আবু জেহেল তার দলবল নিয়ে রাসুলে আকরাম (স:) এর নিকট আগমন করল। এবং উপর্যুপরি নোংরা কথা-বার্তা বলে তাকে অপমান করতে লাগল। তার অশ্রাব্য গালিগালাজের প্রত্যুত্তরে নবী (স:) ওহীর বাণীগুলোই বলতে লাগলেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, এসময় ক্রদ্ধ হয়ে আবু জেহেল রসূল (স:) কে আঘাত করে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রাসূলে আকরাম (স:) বাড়িতে ফিরলেন। এসময় তার চাচা হামযা শিকারের কাজে মক্কার বাইরে ছিলেন। শিকার থেকে ফিরতেই তার কাছে এ সংবাদ যায়। সংবাদ পেয়ে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আবু জেহেলের নিকট পৌঁছলেন। কাবা ঘরের সামনে তাকে পেয়ে সক্রোধে ধনুক দিয়ে তার মাথায় আঘাত করতে লাগলেন এবং হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘পাষণ্ড! আর তুই মুহাম্মাদের উপর অত্যাচার করবি? আচ্ছা, আমিও মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করেছি, কি করবি কর।’ অতঃপর হামজা চলে এলেন মহানবীর কাছে। ইসলাম গ্রহণ করলেন সেদিনই।
দ্বীনের আলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে রাসূলে আকরাম (স:) যে ভাবে বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন, এ যুগেও তার আনীত জীবন বিধান ইসলামের সুমহান শিক্ষা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। সে যুগে যেমন আবু জেহেল, ওতবা, শায়বা, ওয়ালিদরা কুরআন শুনতে মানুষকে বাধা দিত, এ যুগের ওতবা, শায়বা আর আবু জেহেলরাও কুরআনের মাহফিল শুনতে মানুষকে বাধা দেয়। কুরআনের মাহফিলে ১৪৪ ধারা জারি করে। আলেমদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। কিন্তু আছে কি কোন হামযা? যে এসব নির্যাতনকারীদের রুখে দাঁড়াবে? হাতের ধনুক দিয়ে জালিমের মাথায় আঘাত করে বলবে- ‘আমিও ইসলামে শামিল হলাম, কি করবি কর।’