অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আজ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলো বাংলাদেশের রাজনীতি। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। যেমন নতুন নয়, তাদের কারাভোগও। তবে ইতিহাস সাক্ষী, কখনো কখনো এক-একটি মামলা শুধু একজন রাজনীতিবিদ নয়, পুরো দল, সম্প্রদায় বা দেশের ইতিহাসের গতিপথও ঠিক করে দেয়।
দেশের প্রধান বিরোধী দল তথা সরকারি দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দল বিএনপি। দলটি তিনবার বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন হয়েছে। আজ এক রাজনৈতিক মামলায় রাজনৈতিক রায় প্রদান করে দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হলো। এর মাধ্যমে এদেশের রাজনীতিতে আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হলো। সূচনা হলো নব্য বাকশালের।
টানা ৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এই সময়ে দেশের প্রশাসনকে নজিরবিহীনভাবে ব্যবহার করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর স্টীম রোলার চালিয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া এই দলটি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কলঙ্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা দখলের পর বিরোধী মত দমনের মাত্রা আরো বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক ও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর আমীরসহ কেন্দ্রীয় ৫ নেতার ফাঁসি কার্যকর করেছে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে দলটিকে এক প্রকার নেতৃত্বশুণ্য করা হয়েছে। একই সাথে নেতাকর্মীদের হত্যা গুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে মাথা তুলে দাঁড়াতেই দেয়া হচ্ছেনা।
অন্যদিকে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বানিয়ে সেটিকেও দেশের একটি নামসর্বস্ব ও অজনপ্রিয় দলে পরিণত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় দেশের সর্ববৃহৎ জনপ্রিয় দল বিএনপির প্রধানকে রাজনৈতিক মামলায় কারাদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে ও দলটির নেতাকর্মীদের প্রতিবাদের সকল পন্থার উপর খড়গ চাপিয়ে দেশে একদলীয় নব্য বাকশালের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করা হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটি ছিলো রাষ্ট্রের ১৩ হাজার ৬৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে নাইকো দুর্নীতি মামলা। আরেকটি হলো বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি টাকা চাঁদা নিয়ে কাজ দেয়ার অভিযোগে খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলা।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় তার বিরুদ্ধে মোট ১৫টি মামলা ছিলো। তবে কোনো মামলায় তাকে খালেদা জিয়ার মত আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে অনুগত বিচারপতিদের দিয়ে তিনি সবগুলো মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেন। কিন্তু একই ধরণের রাজনৈতিক মামলা হলেও কেবলমাত্র হয়রানি আর প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবেই রেখে দেন খালেদা জিয়ার মামলাগুলো। যার পরিণতিতে আজ খালেদা জিয়া জেলে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেয়া আজকের রায় যে একটি রাজনৈতিক রায় সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই রায় ছিলো সরকারের নকশা অনুযায়ী। আদালতের উপর সরকারের প্রভাব কতখানি সেটা অতিসম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিহনাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই স্পষ্ট বুঝা যায়। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সরকারের সামান্য যৌক্তিক সমালোচনা করে তাকে পদ এমনকি দেশ ছাড়তে হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানকে খালস দিয়ে জনৈক বিচারপতিকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। এসব ঘটনাই প্রমান করে আদালত স্বাধীন নয়। আজকের বিতর্কিত রায়ে সেটা আবারও প্রমাণ হলো।
আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে যখন যুদ্ধাপরাধের বিতর্কিত বিচারে মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেয়া হয় সেই তখন থেকেই। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের রীতি বাংলাদেশে অনেক পুরনো। স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ পিলারটি আজও স্বাধীন হতে পারেনি।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল ও কেবলমাত্র ৪টি রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে একদলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলো। যা বাংলাদেশের রাজনীতির এক কালো অধ্যায়। এই বাকশালের শেষ পরিণতি বাংলাদেশের ইতিহাসে তার চাইতেও করুণ ও নির্মম অধ্যায়। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেইনি। শিক্ষা নেননি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও।
প্রধান বিরোধী নেত্রীকে জেলে পাঠানোর কয়েক ঘন্টা পর সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বরিশালের দলীয় জনসভায় দম্ভের সঙ্গে বলেন ‘আজ তিনি কোথায়’? এ যেনো ১৯৭৫ এর সেই বাকশালেরই প্রতিচ্ছবি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্রীয় গুম ও ক্রসফায়ারের শিকার সিরাজ শিকদার। ১৯৭৫ সালে বাকশালের সমালোচনা করায় তাকে সরকারি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়। তাকে হত্যার পর তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানও দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার’। তখনকার গুম খুনের হোতা ছিলো নৃশংস রক্ষী বাহিনী। বর্তমানের পুলিশ ও র্যাবের গুম খুন আর নৃশংসতা তো রক্ষী বাহিনীকে অতিক্রম করে ফেলেছে।
ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ন্যায় অন্যায়ের ধার ধারেননা তারা। ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী হয়না একথা তারা মালুম ভুলে যান। তাদের অপশাসনের যাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে জনগণ যখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখনই তারা স্বৈরাচারি হয়ে উঠে। বলতে শুরু করে উন্নয়ন আগে গণতন্ত্র পরে। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এভাবেই ধীরে ধীরে একসময়ের একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী দল থেকে স্বৈরাচারি দলে পরিণত হয়েছে। আজ সেই দলটি গায়ের জোরে দেশে একদলীয় নব্য বাকশালের সূচনা করলো।