মুসাফির রাফি
মান্যবর সাবেক বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপীল বিভাগের মোস্ট সিনিয়র বিচারপতি হিসেবে পদত্যাগ করলেন গতকাল শুক্রবার সন্ধায়। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের কাছে লেখা সেই পদত্যাগপত্রে তিনি পদত্যাগের কারনটা ব্যক্তিগত হিসেবে উল্লেখ করলেও সকলেই জানেন যে, তাকে ডিঙ্গিয়ে আপীল বিভাগের আরেক বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেয়াতেই তিনি বিব্রত ও গোস্বা হয়ে পদত্যাগ করেছেন।
আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন আইনজীবি হিসেবে কাজ করেছেন। বিচারপতি হিসেবেও তার ক্যারিয়ার বেশ লম্বা সময়ের। সিনিয়রিটি বিবেচনা করলে প্রধান বিচারপতির চেয়ারে তারই বসার কথা। বিচারপতিদের নিয়ে আমাদের মত সাধারন মানুষের লেভেলে খুব একটা আগ্রহ সাধারনত থাকেনা। আমরা খুব কম মানুষই হাইকোর্ট বিভাগ তো দূরের কথা আপীল বিভাগের বিচারপতিদের নাম বলতে পারবো। তবে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার নামটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সাধারন মানুষ তাকে ভালভাবেই চিনতো এবং তার একটা ইতিবাচক ইমেজও জনগনের কাছে ছিল।
বিশেষ করে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা কথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় অন্য সব বিচারপতি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিলেও বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা সাঈদী সাহেবকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। মুলত তখন থেকেই ওয়াহহাব মিঞা সাধারন মানুষের আলোচনায় উঠে আসেন। এরকম প্রতিকুল একটি সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়, সহকর্মী সকল বিচারপতির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এবং সব রকমের সংস্থা বা এজেন্সীর হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে তিনি যেভাবে সাঈদী সাহেবকে খালাস দিলেন তা রীতিমতো সবাইকে বিস্মিত করেছিল। অনেকেই বলেছিলেন অন্তত একজন বিচারপতি আপীল বিভাগে আছেন যিনি বিচারক হিসেবে জুডিশিয়াস মাইন্ড লালন করেন।
সাঈদী সাহেবের মামলায় ভিন্ন রায় দেয়ার শাস্তি হিসেবে পরবর্তীতে তাকে আর এই মানবতা বিরোধী অপরাধের অন্য মামলাগুলো শোনার সুযোগ দেয়া হয়নি। এমনকি পদচ্যুত সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এই আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা সাহেবকে কোর্টরুম ১ থেকে সরিয়ে কোর্টরুম ৩ এ বদলী করেন। উল্লেখ্য ১ নাম্বার কোর্টরুমেই এই মানবতা বিরোধী মামলার আপীল শুনানীগুলো হতো।
ওয়াহহাব সাহেব সরকারের রোষানলে আবারও পড়েন তত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের সংশোধনীর রায়েও ভিন্ন একটি অবস্থান নিয়ে। সেই সময়ে তিনি তার রায়ে তত্বাবধায়ক সরকার আরো দুই মেয়াদ রাখার সুপারিশ করেছিলেন। এটাও তার জন্য কাল হয়েছে।
আদালত পাড়ায় যারা সচরাচর ঘুরাফেরা করেন, তারা সকলেই জানতেন ওয়াহহাব মিঞাকে কখনোই এই সরকার প্রধান বিচারপতি বানাবেনা। বানানোর প্রয়োজনও ছিলনা। কিন্তু বিধি বাম। সরকারের সব হিসেব নিকেষ পাল্টে যায় যখন সিনহা বাবুর সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। সিনহা যে কোনদিন নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবেন, তা বোধ হয় সরকার স্বপ্নেও ভাবেননি। ফলশ্রুতিতে সরকার থাকলো, বিদায় নিতে হলো বিচারপতি সিনহাকে।
এরপর থেকেই বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার ভিন্ন রূপ আমরা দেখতে শুরু করলাম। জুডিশিয়াস মাইন্ডের এই লোকটি কেমন যেন ভেজা বেড়াল হয়ে গেলেন। তার পূর্বসূরী সিনহা বাবুর দুর্নীতি নিয়েও কোন কথা বললেন না। এটা নিয়ে ভালভাবে তদন্তও করলেন না। অধিকন্তু সিনহা সাহেব প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় দুই একবার এটর্নী জেনারেল বা সরকারের সাথে দ্বন্দ্বে গেলেও ওয়াহাব মিয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেয়ার পর সেরকমও কোন দ্বন্দ্বে জড়ালেন না। বরং অনেকগুলো রায় তিনি সঠিকভাবে দিতে ব্যর্থ হলেন। অন্তত জনগন তার কাছ থেকে যেরকম বিচারিক ভুমিকা আশা করেছিল, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসার পর তিনি জনগনের সেই প্রত্যাশা আর পূরন করতে পারেননি।
অক্টোবরে বিচারপতি সিনহা অধ্যায় শেষ হওয়ার পর গতকাল ২ ফেব্রুয়ারী সরকার সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিল। মাঝে ৩ মাসেরও বেশী সময় দেশে কোন প্রধান বিচারপতি ছিলনা। ওয়াহহাব মিঞা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন এই সময়টাতেই। কিন্তু রাষ্ট্রের তিন গুরুত্বপূর্ন বিভাগের মধ্যে অন্যতম যেই বিচার বিভাগ সেই বিভাগের প্রধান হিসেবে শপথ না নিয়ে একজন ব্যক্তি কিভাবে দায়িত্ব পালন করেন? ওয়াহহাব মিঞার এই ভুমিকাতেও অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
প্রধান বিচারপতির পদটি ভারপ্রাপ্ত রেখে আদৌ চালানো যায় কিনা- সেই মর্মে বেশ কিছু রিটও দায়ের করা হয়েছিল সচেতন আইনজীবিদের পক্ষ থেকে। এগুলোকে হাইকোর্ট বিভাগ থেকেই খারিজ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমেও আসলে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করা হয়। হাইকোর্টের বেঞ্চগুলো গঠনের ক্ষেত্রেও ওয়াহহাব মিঞা বিবেকের প্রতি সুবিচার করেননি। তাই বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা তার আমলেও হাইকোর্ট থেকে ন্যায়বিচার পায়নি। এই ৩ মাস লম্বা সময়েও বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া আপীল বিভাগে নতুন কোন বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেননি। আপীল বিভাগ এখন চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে, মাত্র ৪ জন বিচারপতিকে দিয়ে।
একটু খিটখিটে মেজাজ, স্পষ্টভাষী, এবং জুডিশিয়াস মাইন্ডের মানুষ বলে পরিচিত বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার সুনাম ছিল যে তিনি কারও দালালি করেন না। কিন্তু প্রধান বিচারপতির মুলো ঝুলিয়ে রেখে আওয়ামী লীগ যেমন ৩ মাস তাকে ব্যবহার করলো ঠিক তেমনি তিনি নিজেও তার ব্যক্তিত্ব ও বিবেকবোধকে রসাতলে পাঠিয়ে এমন কিছু কাজ করলেন এবং এমন কিছু কাজ করতে ব্যর্থ হলেন যা তাকে তারকার ইমেজ থেকে এক ঝটকায় ধরনীতে নামিয়ে নিয়ে আসলো। আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতি না হওয়াতে তাই অধিকাংশ সচেতন মানুষই অবাক হননি। বিশ্লেষকরা শুরু থেকেই নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, সরকার কোনভাবেই তাকে প্রধান বিচারপতি বানাবেন না। কিন্তু ওয়াহহাব মিঞা কেন সেই প্রত্যাশাটি করলেন- এটাই হলো প্রশ্ন।
পরিশেষে আফসোস করেই বলতে হয় যে, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা তার পেশাগত জীবনের শেষ সময়টাতে এসে বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে না পারায় তাকে হয়তো বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসের ট্রাজেডি পুরুষ হয়েই থেকে যেতে হবে।