নাঈম আব্দুল্লাহ
দলীয় অনুমোদন না থাকলেও স্কুলকেন্দ্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। স্কুলে ছাত্রলীগের রাজনীতি গত বছরের শেষদিকে দাপ্তরিকভাবে ঘোষণা দিলেও গত কয়েকবছর ধরেই চলছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রলীগের রাজনীতি। যার শিকার হল নগরীর কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান ইসফার (১৫)।
গত মঙ্গলবার বিকেলে নগরীর জামালখান আইডিয়াল স্কুলের সামনে ছাত্রলীগের অপরপক্ষের ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে খুন হয় আদনান। সে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। অনুমোদন না থাকায় কমিটির কোনো পদ বা পরিচিতি নেই তার। তবে সে ওই স্কুলের বড় নেতা। এটাই তার পরিচয়। এই পরিচয়েই স্কুলে ছিল তার দাপুটে পদচারণা। তার রয়েছে একঝাঁক সহপাঠি ছাত্রলীগ কর্মী। যাদের মধ্যে রয়েছে সাকিব, নাজিম, জুনায়েদ, রাফিন ইকবাল, রাসেলসহ অনেকে। এদেরই কয়েকজন গত মঙ্গলবার বিকেলে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত স্কুল ছাত্রলীগ নেতা আদনানকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বলে খবরে প্রকাশ।
প্রশ্ন হচ্ছে স্কুল ছাত্রলীগের এমন দাপুটে নেতাকে হত্যা করলো কারা? কি তাদের পরিচয়? মিডিয়ার কল্যাণে তাদের পরিচয়ও বেরিয়েছে। পুলিশ তাদের কয়েকজনকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা ছোরাসহ গ্রেফতার করেছে। খবর বলছে, হত্যাকারীরা সবাই স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মী। তারা হত্যাকাণ্ডের পর এক ছাত্রলীগ নেতার বাসায় অবস্থান নিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটিও এক ছাত্রলীগ নেতার বলে স্বীকার করেছে হত্যাকারীরা।
মনে করিয়ে দিতে চাই আরও এক স্কুলছাত্র আদনানের কথা। এক বছর আগে রাজধানীর উত্তরায় প্রতিপক্ষের হাতে একইভাবে জীবন দিতে হয়েছিল এই অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে। মিডিয়ায় তখন “কিশোর গ্যাং” সংস্কৃতি নিয়ে কথা বললেও চেপে যাওয়া হয় এর নেপথ্যে থাকা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের সম্পৃক্ততার কথা। অবশ্য কোন কোন গণমাধ্যম অনেকটা সেফ মুডে তুলে ধরেছিল এর নেপথ্যের রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কথা।
উত্তরার এই আদনান হত্যার পর বেরিয়ে আসতে থাকে সারা রাজধানী জুড়ে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা বাহারি নামের ‘কিশোর গ্যাং’ তথা গ্রুপ এর সন্ধান। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মিডিয়াগুলো চেপে গেলেও থেমে থাকেনি কিশোরদের এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই চেপে যাওয়া প্রমাণ করে এর পেছনে জড়িয়ে আছে একটি প্রভাবশালী চক্র। আর এ চক্র যে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কিছু নেই।
চট্টগ্রামের স্কুল ছাত্রলীগ নেতা আদনান ইসফারের মতই গত বছরের ০৭ মে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি মুজিবুর রহমান জাবুকে (১৬) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। সে পালংখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
৯ ডিসেম্বর ২০১৭ মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন স্কুল কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে সংঘর্ষে দুই কর্মী নিহত হয়। নিহত একজন সরকারি স্কুলের ছাত্র, অপরজন সরকারি স্কুল থেকে পাশ করা সদ্য বিদায়ী ছাত্র এবং দু’জনই জেলা ছাত্রলীগের একই গ্রুপের কর্মী বলে জানা যায়।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ হোসেনের বিরুদ্ধে তার দলের স্কুল কমিটির এক নেত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায় গত ২৪ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে। ধর্ষিতা স্কুল ছাত্রী বেলকুচির দৌলতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ও একই বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বলে খবরে প্রকাশ।
শুধু তাই নয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ধারাবাহিকতায় শিক্ষক পেটানোর মত গর্হিত কাজ করে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছে এক স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতি। এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় নকল ধরার কারণে দলীয় সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে শিক্ষক সন্তোষ দেউরীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায় পিরোজপুর শ্রীরামকাঠী ইউজেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আমানত শান্ত।
আর সম্ভবত ছাত্রলীগের এসব আমলনামার দিকে খেয়াল করেই গত বছরের শেষপ্রান্তে এসে ২৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি না করার নির্দেশ দেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন ‘স্কুল কমিটির ধারণাটা সঠিক হয়নি, এটা করে এখন সমালোচনা ডেকে আনার দরকার নেই।’ এর আগে ২১ নভেম্বর মাধ্যমিক স্কুলে কমিটি তৈরি করতে সব সাংগঠনিক ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সেদিনের নির্দেশের থোরাই কেয়ার করে ছাত্রলীগ। আর তার ফল পাওয়া গেল মাত্র ১ মাসের মাথায় চট্টগ্রামে ঝরে গেল স্কুল ছাত্র আদনান। ছাত্ররাজনীতির উজ্জল ইতিহাসকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়া এই ছাত্র সংগঠনটি এখন দেশবাসীর জন্য এক ভয়ানক বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে কি দেশের বিজ্ঞজনেরা মোটেও ভাবছেন? ভাবলেও কি তার কোন প্রতিফলন মিলবে?