একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পক্ষে মত দিয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। ৪০টি দলের মধ্যে ২৫টিই এ প্রস্তাব দিয়েছে। ১৯টি দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে। তবে ৮টি দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৪ আগস্ট থেকে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ৪০টি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। দলগুলোর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে চার শ প্রস্তাব জমা পড়েছে।
সাবেক ও বর্তমান একাধিক নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, সংলাপে প্রাধান্য পাওয়া সব বিষয় বাস্তবায়ন করা একা ইসির পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। কারণ, এ ক্ষেত্রে আইন ও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ না চাইলে তা হবে না।
নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রস্তাব সংকলন করে তা সরকার ও সব দলকে দেওয়া হবে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন-সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কোনটা নিয়ে কী করা যায়, কমিশন বসে তা ঠিক করবে।
ইসিকে দেওয়া দলগুলোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পক্ষে মত দিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপিসহ ১০টি দল সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনের পক্ষে। দলটি বলেছে, কোন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা যাবে, তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারায় বলা আছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বেআইনি সমাবেশ অন্য কোনো উপায়ে ছত্রভঙ্গ করা না গেলে এবং জননিরাপত্তার জন্য তা ছত্রভঙ্গ করা প্রয়োজন বলে বিবেচিত হলে সর্বোচ্চ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সামরিক শক্তি দিয়ে তা ছত্রভঙ্গ করতে পারবেন।
প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মূল প্রস্তাবগুলো পরস্পরবিরোধী। বিশেষ করে সেনা মোতায়েন, সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তন, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে দুই দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ বহাল রাখা না-রাখা নিয়ে আওয়ামী লীগ ইসিতে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব না দিলেও এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের অবস্থান বিএনপির বিপরীত।
এ অবস্থায় প্রধান দুই দল পরস্পরকে কতটা ছাড় দিতে প্রস্তুত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এটা একটা মীমাংসিত বিষয়। কেননা, ২০১৪ সালে বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হয়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন শেখ হাসিনা। এটা মেনে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে।
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকালে সহায়ক সরকার, তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন—এগুলো নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মৌলিক বিষয়। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনেরা যদি আবারও ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ায় যায় এবং নির্বাচন কমিশন এর সহায়ক হয়, তাহলে এর মূল্য তাদের দিতে হবে।
বর্তমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ইসি চাইলে আপৎকালীন বাহিনী (স্ট্রাইকিং ফোর্স) হিসেবে সেনা মোতায়েন করতে পারে। আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে বা সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হলেও আইনের সংশোধনী আনতে হবে।
বিএনপি, কল্যাণ পার্টি, মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিস, জাগপা, জাতীয় পার্টি (মতিন), বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও জেএসডি বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করার প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা) ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণফ্রন্ট, জমিয়তে ওলামা ইসলাম বাংলাদেশ, তরিকত ফেডারেশন, গণফোরাম, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, এলডিপি, বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার প্রস্তাব করেছে।
বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া দল এনপিপি ও ইসলামী ঐক্যজোট ঢালাওভাবে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার প্রস্তাব দিয়েছে। সাম্যবাদী দল বলেছে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে। ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এর বাইরে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন ও বাসদ সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিপক্ষে মত দিয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, আরপিওর সংজ্ঞায় থাক বা না থাক, ইসি চাইলে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে পারে। এটা নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।
নির্বাচনকালীন সরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকে তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। দাবি পূরণ না হওয়ায় দলটি গত সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। এখন তারা ‘নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের দাবি করছে।
ইসির সংলাপে বিএনপি ছাড়াও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাগপা, বাংলাদেশ ন্যাপ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিস ও কল্যাণ পার্টি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছে। জমিয়তে ওলামা ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি করেছে।
ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকেবলেন, যাঁরা এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁরাও জানেন কমিশনের এখতিয়ারে কী আছে, কী নেই। তবে তাঁরা ইসিকে এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে কী করা যায়, সংলাপ শেষে নির্বাচন কমিশন বসে তা ঠিক করবে।
সংসদ ভেঙে দেওয়া
বর্তমান সংবিধানে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে যেকোনো সময় নির্বাচন করার বিধান আছে। এ সময় সংসদ সদস্যরা পদে বহাল থাকবেন। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ (জাপা) ১৯টি দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। অনেকে যুক্তি দেখিয়েছেন, এই বিধান থাকলে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে না। কারণ, এতে বর্তমান সাংসদেরা বিশেষ সুবিধা পাবেন।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া, সহায়ক সরকার গঠন করা—এগুলো ইসির এখতিয়ারে নেই। এগুলো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়। ইসি সংবিধানের মধ্যে থেকে কাজ করবে। তারপরও ইসিকে এখন থেকে ভাবতে হবে তাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সবার জন্য সমান সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হলে কীভাবে মোকাবিলা করবে। এ জন্য নতুন আইন বা বিধির প্রয়োজন আছে কি না। থাকলে তা সরকারের কাছে তুলে ধরতে পারে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
আওয়ামী লীগ ও এর জোটের দুই শরিক জাসদ ও সাম্যবাদী দল এবং বিকল্পধারা, এলডিপিসহ কয়েকটি দল আগামী নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ না করার প্রস্তাব দিয়েছে। আর বিএনপি ২০০৮-এর আগের মতো করে আসনের পুনর্বিন্যাস চেয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আগে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছিল নির্বাচনে ‘না’ ভোট আবার চালু করার প্রস্তাব। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, পিডিপি, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, জেএসডি, বিকল্পধারা, সিপিবি, সাম্যবাদী দলসহ কয়েকটি দল ‘না’ ভোট চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা না-করা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ইভিএমের বিপক্ষে। তবে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ইসলামী ফ্রন্ট, গণফ্রন্ট, তরিকত, সাম্যবাদী দল, জাকের পার্টিসহ কয়েকটি দল বলেছে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ছাড়া অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধান করা, পর্যবেক্ষক নিয়োগে সতর্ক থাকা, প্রবাসীদের ভোটার করা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন সময়ে কমিশনের অধীনে রাখা, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার বন্ধ করা, যুদ্ধাপরাধীদের দলের নিবন্ধন না দেওয়া, সব প্রার্থীর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ভোট গণনা ও কেন্দ্রে ফল ঘোষণা, ইসির কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় ১ শতাংশ সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বাধ্যবাধকতা বাতিল, জামানতের টাকার পরিমাণ কমানোসহ বিভিন্ন প্রস্তাব ঘুরেফিরে এসেছে দলগুলোর কাছ থেকে। এর মধ্যে ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং সহায়ক সরকারের দাবি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বল এখন ইসির কোর্টে। দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মানদণ্ড হলো নির্বাচনে জয়ী হওয়া। আর নির্বাচন কমিশনের মানদণ্ড হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সে আলোকেই ইসিকে প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, অনেক প্রস্তাব বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। তবে যেগুলো ইসি বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেগুলো তাদের করা উচিত। আর যেগুলো সরকারের বিষয়, সেগুলো নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। সরকার না শুনলে সে অবস্থায় ইসি যদি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে সেটা তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post