আজম খান
ইউনেস্কো সুন্দরবনের কাছে বিতর্কিত কয়লা-ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে বলে কয়েক দিন আগে বেশ আত্মতুষ্টির সঙ্গে ঘোষণা করলো বাংলাদেশ সরকার। এতে বিভ্রান্তিতে পড়লো জনগণ। তাহলে বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ বনের কাছে রামপাল নির্মাণের ঝুঁকি নিয়ে এতদিন ধরে পরিবেশবিদরা যেসব কথা বলে আসছেন তার কি হবে? এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের জন্য আসলেই কি কোন ঝুঁকি সৃষ্টি হবে না? আসলেই কি রামপালের শব্দ বাঘের গর্জন থামিয়ে দেবে না, সুন্দরবন কি আগের মতোই তার উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল নিয়ে টিকে থাকতে পারবে?
পরিবেশ আন্দোলনকারী, পরিবেশবিদ ও সচেতন নাগরিক সমাজের কেউ সরকারের কথায় আস্থা রাখতে পারেনি। বিশেষ করে ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা যখন সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে গুরুতর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এত সহজেই তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে গেলো? কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে অকাট্য তথ্য-উপাত্ত থাকার পরও সেগুলোর প্রতি সংস্থাটি চোখ বন্ধ করে থাকবে? সরকারের ঘোষণার পরপরই এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ শুরু করেন তা সত্যে পরিণত হতে বেশি বিলম্ব হয়নি।
প্রমাণিত হয়েছে সরকার সুস্পষ্ট মিথ্যাচার করেছে। ইউনেস্কো কখনোই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। সংস্থাটি আগাগোড়াই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে এবং সম্প্রতি পোল্যান্ডের ক্রাকোতে অনুষ্ঠিত সংস্থার বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি’র ৪১তম সভায় সর্বসম্মতভাবে ওই কথা বলা হয়েছে।
রামপাল কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এগিয়ে নিতে ইউনেস্কো অনুমতি দিয়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে তার পক্ষে সংস্থাটি থেকে জনসম্মুখে প্রকাশ করা সিদ্ধান্তের কথা কোথাও পাওয়া যায়নি। বিশ্বঐতিহ্য কমিটি’র ৪১তম সভায় গৃহীত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে একটি রিপোর্ট গত রোববার (৩০ জুলাই) জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, জাতিসংঘ শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ওপর রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিরূপনের জন্য একটি কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়ন (এসইএ)-এর আহ্বান জানাচ্ছে।
ইউনেস্কো সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে এই মূল্যায়ন সম্পন্ন হওয়ার আগে ওই অঞ্চলে কোন বৃহৎ শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সংস্থাটি আগে যেসব শর্ত আরোপ করেছে সেগুলো এখনো বহাল রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ এগিয়ে নিতে ইউনেস্কো অনুমতি দিয়েছে বলে সরকার যে দাবি করেছে তা সঠিক নয়।
বিশ্বঐতিহ্য কমিটির বৈঠক শেষ হয় ১২ জুলাই এবং এতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশিত হয় আরো ১৮ দিন পর। ওই বৈঠক চলার সময় গত ৭ জুলাই বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, ইউনেস্কো ২ জুলাই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নিয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনকে বিশ^ ঐতিহ্য তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপাদেষ্টা তৈফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী ক্রাকো বৈঠক থেকে ফেরার পর ১০ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে রামপালের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হলে বলেন, আপাতত সরকার সুন্দরবনের কাছে কোন ধরনের বৃহৎ শিল্প অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেবে না। তবে, কয়লা-ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বন্ধ হবে না।
বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় গৃহীত ৭ নং সিদ্ধান্তে বলা হয় যে ২০১৬ সালে ‘রিএ্যাকটিভ মনিটরিং মিশন’ যেসব সুপারিশ করছে তার সবগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ বলেন, ইউনেস্কোর প্রধান আপত্তি ছিলো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে। তাদের খসড়া সিদ্ধান্তে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের আহ্বান জানানো হয়। তবে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তির মুখে বিশ্বসংস্থা রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নেয় বলে প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন। ফলে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন বাধা নেই।
অন্যদিকে, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত মেনে নেবে বলে বৈঠকে অঙ্গীকার করে এসেছে। ফলে সরকার যেহেতু ইউনেস্কোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে তাই রামপাল নির্মাণ কাজ বন্ধ করতে হবে।
বিশ্বঐতিহ্য কমিটির সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর প্রমাণিত হলো যে রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে ইউনেস্কা আপত্তি তুলে নিয়েছে বলে সরকার যে বিবৃতি দেয় তা ছিলো মিথ্যা। এর শেষ কথা হলো, সুন্দরবন বাঁচাতে চাইলে রামপাল প্রকল্প অবশ্যই বাতিল করতে হবে।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি’র ৪১তম সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ওয়াটার কিপার্স এলায়েন্স’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফ জামিল বলেন, রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে ইউনেস্কো ‘রিএ্যাকটিভ মনিটরিং রিপোর্ট’-এ তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সুন্দরবনের আশপাশে রামপালসহ কোন শিল্প বা অবকাঠামো স্থাপন করা যাবে না বলে তারা সুপারিশ করেছে। তিনি বলেন, বিশ্বঐতিহ্য কমিটি’র বৈঠক থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালনি উপদেষ্টা যে কথা বলেছেন তা অসত্য।
দুই পৃষ্ঠার রিপোর্টের ১১ নং সিদ্ধান্তটি ছিলো বাংলাদেশকে নিয়ে। তাতে বলা হয়, সিন্ধান্ত নেয়া হলো যে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ওপর যত দ্রুত সম্ভব একটি ‘কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়ন’ করবে এবং তার রিপোর্ট বিশ^ ঐতিহ্য কমিটির কাছে পাঠাবে। এরপর কমিটি তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন)’র কাছে পাঠাবে। ১১ নং সিদ্ধান্তে আরো বলা হয় যে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ^ ঐতিহ্য কমিটির পর্যালোচনার জন্য সম্পদ সংরক্ষণ ও শর্তাবলী বাস্তবায়নের অবস্থা সম্পর্কিত একটি হালনাগাদ রিপোর্ট ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে পাঠাতে হবে।
সুন্দরবন সম্পর্কিত বিশ্বঐতিহ্য কমিটি সিদ্ধান্ত
বিশ্বঐতিহ্য কমিটি:
১. ডব্লিউএইচসি/১৭/৪১.সিওএম/৭বি ডকুমেন্ট পর্যালোচনার পর
২. (বন, ২০১৫) ৩৯তম সভায় গৃহীত ৩৯ সিওএম ৭বি.৮ সিদ্ধান্ত স্মরণ করছে;
৩. অরিয়ন বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যায়-২ অনুমোদন না করার ব্যাপারে রাষ্ট্র পক্ষের সিদ্ধান্ত স্বাগত জানাচ্ছে;
৪. বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে একটি ‘কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়ন’ (এসইএ) পরিচালনার ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং এসইএ সম্পন্ন হওয়ার আগে যেন কোন বৃহৎ শিল্প এবং/ বা অবকাঠামো উন্নয়নের অনুমতি না দেয়া হয় তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইইউসিএন’র পর্যালোচনার জন্য যত দ্রুত সম্ভব এসইএ রিপোর্টের একটি কপি বিশ্বঐতিহ্য সেন্টারে পাঠানোর জন্য বলা হচ্ছে;
৫. ইকোলজিকাল মনিটরিং-এর ব্যাপারে তথ্য প্রদানকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবনাক্ততা প্রবেশ এবং মৃদুপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এর ফলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হয়েছে;
৬. বিশ্ব ঐহিত্য সম্পদ সুন্দরবন রক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোর মধ্যে আন্ত:সীমান্ত সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। উভয় রাষ্ট্রীয় পক্ষ সহযোগিতা জোরদার করতে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। আর বনজ সম্পদে পর্যাপ্ত মৃদুপানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালের মিশন রিপোর্টের সুপারিশ পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্র পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে;
৭. ২০১৬ সালের মিশন রিপোর্টের অন্যান্য সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে;
৮. ‘ন্যাশনাল অয়েল স্পিল এন্ড ক্যামিকেল কনটিনজেন্সি পরিকল্পনা’ (এনওএসসিওপি)’র খসড়া তৈরিকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং এই পরিকল্পনা অনুমোদনের পর তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল ও মানব সম্পদ যোগান নিশ্চিত করা এবং সুন্দরবনের কাছে সম্প্রতি যেসব জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে সেগুলো থেকে বিপজ্জনক বর্জ ছড়িয়ে পড়ার ফলে দীর্ঘ-মেয়াদি প্রভাব পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহের জন্য রাষ্ট্র পক্ষকে অনুরোধ করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে একটি জাহাজ চলাচল ও ড্রেজিং ব্যবস্থাপনা গ্রহণের জন্যও রাষ্ট্র পক্ষকে অনুরোধ করা হচ্ছে;
৯. পশুর নদীতে নতুন করে খননকার্য চালানের আগে ‘পরিবেশগত প্রভাব মুল্যায়ন’ (ইআইএ) এবং একই সঙ্গে কমিটির অনুরোধক্রমে সুন্দরবনের ‘আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালু’ (ওইউভি)’র ওপর প্রভাব মূল্যায়নের জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে অনুরোধ করা যাচ্ছে;
১০. রামপাল কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে বায়ু ও পানি দূষণ, জাহাজ চলাচল ও ড্রেজিং-এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি এবং মৃদুপানি আরো ঘাটতির ফলে পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের ব্যাপারে মিশনে’র উদ্বেগ আমলে নিয়ে বিশ্ব ঐহিত্য কমিটি’র ৪১তম সভায় গৃহিত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে;
১১. পরিশেষে রাষ্ট্র পক্ষের প্রতি সম্পত্তি সংরক্ষণের অবস্থা এবং উপরের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন সম্পর্কিত একটি হালনাগাদ রিপোর্ট ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। এই রিপোর্ট ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি’র ৪৩তম বৈঠকে পর্যালোচনা করা হবে।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
Discussion about this post