মহিউদ্দিন আহমদ
২৩ জুন আওয়ামী লীগের জীবনে একটি বড় ঘটনা। ১৯৪৯ সালের এই দিনে জন্ম নেওয়া দলটি ৬৮ বছর পেরিয়ে আজ ৬৯-এ পা দিল। এ দেশে রাজনৈতিক দল গজায় ব্যাঙের ছাতার মতো, আবার বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যায়। দল ভেঙে ছত্রখান হওয়ার নজিরও কম নয়। আওয়ামী লীগও ভেঙেছে বারবার। তবে এর মূল ধারাটি সচল রয়েছে এখনো। আওয়ামী লীগের অগুনতি নেতা-কর্মীকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
একটি দল পুরোনো না নতুন, তার ওপর ওই দলের ভালো-মন্দ নির্ভর করে না। এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের কালজয়ী সৃষ্টি শ্রীকান্ত থেকে কয়েকটি লাইন ধার করে বলা যায়, ‘টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নহে। অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।’ ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় জন্ম নেওয়া মুসলিম লীগ ১৯৪৮ সালে পচে গিয়েছিল। অথচ আওয়ামী লীগ জন্ম নেওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালে জনগণের ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হতে পেরেছিল ।
ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে সাতটি দশক। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আওয়ামী লীগ কতটুকু এগোল। এখন আওয়ামী লীগকে নিছক একটি রাজনৈতিক দলের কাতারে ফেলা যায় না, যেমনটি বলা যায় কয়েক ডজন খুচরো দলের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ এই কয়েক দশকে কয়েকবার সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। আদর্শিক রাজনীতির রূপান্তর ঘটেছে ক্ষমতার রাজনীতিতে। ক্ষমতার রাজনীতির দুটি দিক আছে। নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারে যেতে হয়।
রাষ্ট্রক্ষমতার চাবিটি হাতে পাওয়া এ জন্য খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা হলো মাধ্যম বা হাতিয়ার, যা লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। অন্যদিকে ক্ষমতা পাওয়াটাই যদি লক্ষ্য বা অভীষ্ট হয়ে দাঁড়ায়, তখন দলের মধ্যে মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটে যায়। একটানা ক্ষমতায় থাকলে একটি দলের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যায়। তাদের মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে পড়ে, তাদের বুঝি কোনো বিকল্প নেই, তারা অপরিহার্য।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের দখল নিলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর ইচ্ছাতেই দেশ চলবে। তিনি সব সময় বলতেন, যেখানে পীর-ফকিররা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে মানুষ সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি, সেখানে কেমন করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যাবে? সুতরাং তিনি একটা ‘দেশজ ব্যবস্থা’ উদ্ভাবন করলেন। নাম দিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। ইউনিয়ন কাউন্সিলের (এখন নাম ইউনিয়ন পরিষদ) ৮০ হাজার সদস্যকে নিয়ে তিনি তৈরি করলেন ইলেক্টোরাল কলেজ। তাঁরাই সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। সমালোচকেরা বললেন, আইয়ুব খান ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করেছেন।
সময়টা তখন একনায়কতন্ত্রের। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্ণ ১৯৬৫ সালে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করলেন। এক সামরিক অভ্যুত্থানে এক বছরের মাথায় তাঁর পতন হলো। আইয়ুব খানকে আজীবন প্রেসিডেন্ট বানানোর সুপারিশ করার লোকের অভাব ছিল না। তিনি তখন দুটি শব্দের ওপর খুব জোর দিতেন—উন্নয়ন ও ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ দেশে তরক্কি আনতে হলে তাঁকেই ক্ষমতায় রাখতে হবে। একবার তিনি একটা ‘সফল বিদেশ ভ্রমণ’ সেরে দেশে ফিরে এলে তাঁকে সোনা দিয়ে মাপার পরিকল্পনা হয়েছিল। কথা ছিল ওজন করে ওই পরিমাণ সোনা তাঁকে ‘উপহার’ দেওয়া হবে। শেষমেশ সেটা হয়নি।
তবে ১৯৬৮ সালজুড়ে সারা দেশে সরকার ঘটা করে ‘উন্নয়ন দশক’ পালন করেছিল। বছর শেষ হওয়ার পৌনে তিন মাসের মাথায় তাঁর ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’ হলো। তাঁর শেষ জীবনটা ছিল করুণ। তাঁর হাতে গড়া ইসলামাবাদ শহরে তাঁর নামে একটি কানাগলিও নেই। মোসাহেবরা একসময় তাঁকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় জাতির পিতা বলতে শুরু করেছিল। তারা বলত, কায়েদে আজম জিন্নাহ স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, আইয়ুব খান দিয়েছেন উন্নয়ন। বলা বাহুল্য, জিন্নাহর জীবনের শেষ দিনগুলোও ছিল করুণ। একনায়কেরা ক্ষমতার চূড়ায় বসে কল্পনাও করতে পারেন না, সামনের দিনগুলো কেমন যাবে।
আমিই সবচেয়ে যোগ্য, আমিই সবচেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক, আমিই মানুষকে সব অধিকার দিয়েছি, আমি না থাকলে দেশ রসাতলে যাবে—এ ধরনের বাগাড়ম্বর উপনিবেশ-উত্তর সব সমাজেই কমবেশি শোনা যায়। চাটুকার-মোসাহেব পরিবেষ্টিত এসব দেশনায়ক বুঝতে অক্ষম যে কীভাবে তাঁদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।
এত কথা বললাম এ জন্য যে বাংলাদেশের এখনকার অবস্থাটা স্বস্তিকর মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এখন দেশের হাল ধরে
আছে। দল সভাপতি শেখ হাসিনার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। তিনি বলছেন, তিনি আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে উন্নয়নের এই গতি থেমে যাবে, এই আশঙ্কার কথা তিনি বলছেন। তাঁর কথার অর্থ দাঁড়ায়, এ দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। কয়েক দিন আগে জাতীয় সংসদে সরকারের ছোট তরফ জাতীয় পার্টির একজন সাংসদ মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন, শেখ হাসিনাকে আরও দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকতে হবে। দরকার হলে বিনা ভোটে।
এই ধরনের চিন্তা সুবিধার মনে হচ্ছে না।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ও এর প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিকল্প ছিল না। জাতীয় সংসদের ৩০০ সদস্যের মধ্যে ২৯২টিই আওয়ামী লীগের থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কেন একদল ‘বাকশাল’ বানালেন, তা আজও অনেকের বোধের বাইরে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অনেক বছর পর আবার সরকার গঠন করার সুযোগ পেয়েছিল।
১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আমরা দেখেছি, কোনো দল পরপর দুবার সরকার গঠন করতে পারেনি। নাগরিকেরা ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করেছিলেন। প্রতিবারই দেখা গেছে, প্রথম দু-এক বছর সরকার ভালোই চলে। শেষ দিকে এসে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জবরদখল লাগামহীন হয়ে পড়ে। ভোটাররা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে এক দলকে বাদ দিয়ে আরেক দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এর ফল যে সব সময় ভালো হয়, তা–ও নয়। তবু নাগরিকদের হাতে যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষমতা থাকে।
২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় আছে। আগামী নির্বাচনে তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেবেন নাগরিকেরা। স্বাধীনভাবে ওই সিদ্ধান্ত নাগরিকেরা নিতে পারবেন কি না, তার ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং নির্বাচন পরিচালনাকারী নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সক্ষমতা ও ভাবমূর্তি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কতটুকু সক্ষম বা পরিপক্ব, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আগামী নির্বাচনে।
আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এখন থেকেই মরিয়া। প্রতিদিন আমরা তাদের বাগ্যুদ্ধ দেখছি এবং শুনছি। নির্বাচনে জেতার জন্য তৈরি হচ্ছে নানা রকমের সমীকরণ। এত দিন একটা প্রচার ছিল, আওয়ামী লীগ মুসলমানবিরোধী দল আর বিএনপি হলো মুসলমানের দল। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আওয়ামী লীগ এই বিশাল ভোটব্যাংকটায় হাত বসানোর চেষ্টা করছে অনেক বছর ধরে। ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে আওয়ামী লীগ নিজেদের খাঁটি মুসলমানের পার্টি হিসেবে জনমনে একটা ধারণা দিতে চেয়েছিল। এক-এগারো ঘটে যাওয়ায় ওটা আর তেমন কার্যকর হয়নি, আওয়ামী লীগও এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেনি।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মাশ্রয়ী দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা একটা বার্তা দেয়। মুসলমানের দল হিসেবে বিএনপির মনোপলি আওয়ামী লীগ ভাঙতে চায়, চায় বিএনপিকে ধর্মাশ্রয়ী গোষ্ঠীগুলো থেকে যদ্দুর সম্ভব দূরে সরাতে। এটা কি আওয়ামী লীগের ভোটের রাজনীতির কৌশল? নাকি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভাবজগতে দিনবদলের হাওয়া লেগেছে? সাত দশক পার করা দলটির কাছে এর উত্তর পাওয়া দরকার।
আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল মুসলমানের দল হিসেবে। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক তখন ‘মূল দাবি’ নামে পুস্তিকা আকারে একটি কর্মসূচি উপস্থাপন করেছিলেন, তা পরে কিছুটা সংশোধন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’–এর ঘোষণাপত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। মূল দাবিতে বলা হয়েছিল, ‘…মুসলিম লীগকে সত্যিকার শক্তিশালী মুসলিম লীগ বা মুসলিম জামাত বা মুসলিম জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে পরিণত করিতে হইলে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে ইহার সদস্য শ্রেণিভুক্ত করিতে হইবে…।’
‘জনগণের মুসলিম লীগ’ হিসেবেই আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র অর্জনের লড়াই চালিয়ে এসেছে। এত বছর পর প্রশ্ন জেগেছে, আওয়ামী লীগ কি পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক হতে পেরেছে, নাকি অবচেতনে সুপ্ত থাকা আদি ঘোষণাপত্রের ধারণা নতুন করে জেগে উঠেছে। আওয়ামী লীগ কি ভোটের জন্য কৌশল পাল্টাচ্ছে, নাকি শিকড়ে ফিরে যাচ্ছে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post