ট্রাম্প প্রশাসন ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধ করে এর ১৩ শতাধিক কর্মীকে প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এর মাধ্যমে কি ‘মার্কিন বিশ্বায়নের’ সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে? আর এই উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত তারকা মিডিয়া ব্র্যান্ডগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে? এসব সিদ্ধান্ত ‘মার্কিন আঞ্চলিকীকরণ’ পরিকল্পনার সাথে কি সঙ্গতিপূর্ণ?
অনেক দেশেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। এসব দেশে মিডিয়া এবং সাংবাদিকদের জন্য তহবিল শেষ হয়ে আসছে। এর প্রভাব দেখা যাবে এ খাতের অর্থে পরিচালিত অনেক প্রকাশনা একের পর এক বন্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে। আমেরিকান বিশ্বব্যাপী সফট পাওয়ারের ওপর যে এর প্রভাব পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন হলো কোন পথে এগোতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন ও রিপাবলিকান টিম!
রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ১৪ মার্চ যে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন তাতে আটটি ফেডারেল এজেন্সি ভেঙে দেয়া হতে পারে। রাষ্ট্রপতির আদেশে এজেন্সিগুলোকে সমস্ত অ-আইনগতভাবে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বন্ধ করার, কর্মীদের চাকরিচ্যুতির এবং আইন দ্বারা প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিধিবদ্ধ ভূমিকা হ্রাস করার নির্দেশনা রয়েছে। হোয়াইট হাউজের একটি তথ্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, জবকাটগুলো ‘জবাবদিহি বাড়ানো, অপচয় কমানো এবং উদ্ভাবন বিকাশের লক্ষ্যে নিবেদিত।’ ট্রাম্পের আদেশে উল্লেøখ করা হয়েছে, আটটি এজেন্সি বন্ধ করার ফলে সরকারি অগ্রাধিকারগুলো গতি পাবে ও করদাতাদের ডলার সাশ্রয় হবে।
ট্রাম্পের আদেশে বাদের তালিকায় যেগুলোর নাম রয়েছে তার মধ্যে আছে ফেডারেল মধ্যস্থতা ও সমঝোতা পরিষেবা, ইউনাইটেড স্টেট এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়া, উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ইনস্টিটিউট অব মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি সার্ভিসেস, ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারএজেন্সি কাউন্সিল অন হোমলেসনেস, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ফান্ড এবং সংখ্যালঘু ব্যবসায় উন্নয়ন সংস্থা।
এই পদক্ষেপের মধ্যে বেশি আলোচিত হলো ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়া (ইউএসএজিএম) বন্ধ করা, যা ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) ও রেডিও ফ্রি এশিয়া পরিচালনা করে। প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক বাজেটের এই এজেন্সির মাধ্যমে ৬০টিরও বেশি ভাষায় এবং প্রায় ১০০টি দেশে নেটওয়ার্ক সম্প্রচার করা হয়।
এর আগে রাষ্ট্রপতি ইউএসএজিএমের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য রক্ষণশীল মিডিয়া ওয়াচডগ ব্রেন্ট বোজেলকে মনোনীত করেন। আর এর মধ্যে, প্রাক্তন সংবাদ উপস্থাপক কারি লেককে ভিওএ পরিচালনা করার জন্য বাছাই করা হয়েছে। লেক কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি বোঝেন কেন ভিওএ ভেঙে দেয়ার আহ্বান রয়েছে, তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, এটিকে উন্নত করা যেতে পারে। তিনি ৩ মার্চ ইউএসএজিএমের সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন এবং তিনি ভিওএ-এ তার মনোনয়নের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় ছিলেন।
শুক্রবারের নির্বাহী আদেশ ফেডারেল সরকারের আকার কমাতে, অপ্রয়োজনীয় এজেন্সি ও উপদেষ্টা কমিটিগুলো বাদ দেয়ার ভিত্তি তৈরি করে। এগুলো হলো ফেডারেল আমলাতন্ত্রের পুনর্নির্মাণ এবং এর কর্মকাণ্ড আরো দুর্বল করতে ট্রাম্পের নেয়া সর্বশেষ পদক্ষেপ। ট্রাম্প প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ককে সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) বিশেষ সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপ মাস্কের পরামর্শেই নেয়া হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত ডিওজিইর প্রচেষ্টায় ২৩ লাখ সদস্যের ফেডারেল বেসামরিক কর্মীবাহিনীর মধ্যে এক লাখেরও বেশি কর্মীর চাকরি চলে গেছে। এর মধ্যে করদাতাদের আনুমানিক ১১৫ বিলিয়ন ডলার বাঁচানোর জন্য অনেক প্রকল্পের বিদেশী সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে এবং হাজার হাজার চুক্তি ও প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ও তার প্রশাসনের ‘ঐতিহাসিক স্তরে’ ফেডারেল ব্যয় হ্রাস এবং সরকারকে সংস্কার করার উপায় খুঁজে বের করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি ২০২৬ সালে স্বাধীনতা দিবসে তার নির্ধারিত ডিওজিই বিলুপ্তির আগে এর জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ চিহ্নিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।
ভয়েস অব আমেরিকা বন্ধে কী হবে
ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়া নেটওয়ার্ক যা আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য টেলিভিশন, রেডিও ও ডিজিটাল সংবাদসামগ্রী তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি প্রচারণার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ১৯৪২ সালে প্রতিষ্ঠিত ভিওএর প্রাথমিক ভূমিকা হলো বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত, সেখানে ‘সঠিক’ ও ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদ সরবরাহ করা।
লিঙ্কডইন পোস্টে, ভয়েস অব আমেরিকার পরিচালক মাইক আব্রামোভিটজ ভিওএর কার্যক্রম হঠাৎ স্থগিত করার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এটিকে সংগঠনের লক্ষ্যের উপর অভূতপূর্ব আঘাত বলে অভিহিত করেছেন। আব্রামোভিটজ লিখেছেন, ‘আমি গভীরভাবে দুঃখিত যে, ৮৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো, বিখ্যাত ভয়েস অব আমেরিকার কণ্ঠ নীরব করা হচ্ছে। আজ সকালে, আমি জানতে পেরেছি, কার্যত ভিওএর পুরো কর্মীবাহিনী অর্থাৎ এক হাজার ৩০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক, প্রযোজক এবং সহায়তাকর্মীকে প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত। ভিওএর চিন্তাশীল সংস্কার প্রয়োজন এবং আমরা সে ক্ষেত্রে অগ্রগতিও অর্জন করেছি। তবে এখনকার এই পদক্ষেপ সংস্থাটিকে তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে অক্ষম করে তুলবে।’
তিনি ভিওএর কাজের বিশ্বব্যাপী গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ভুল তথ্য মোকাবেলায় এই মিশনটি আগের চেয়েও এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণÑ ইরান, চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিপক্ষগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অসম্মানিত করার জন্য মিথ্যা বর্ণনা ছড়িয়ে দিতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ভিওএ আমেরিকার গল্প বলে এবং বস্তুনিষ্ঠ, ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ প্রদান করে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করে, বিশেষ করে যারা নিপীড়ক শাসনের অধীনে বাস করে তাদের জন্য। এমনকি যদি সংস্থাটি কোনোভাবে চলতেও থাকে, তবুও প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপগুলো একটি নিরাপদ এবং মুক্তবিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে দুর্বল করবে, শেষ পর্যন্ত মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে।’
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশটি ভিওএর বাইরেও বিস্তৃত, যা রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি, রেডিও ফ্রি এশিয়া এবং রেডিও মার্টিসহ ইউএস এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়ার (ইউএসএজিএম) অধীন অন্যান্য সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করে। এই সংস্থাগুলো ঐতিহাসিকভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনাধীন অঞ্চলে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টির সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টিফেন ক্যাপাস সতর্ক করে বলেছেন, তাদের অনুদান চুক্তি বাতিল করা ‘আমেরিকার শত্রুদের জন্য একটি বিশাল উপহার হবে’।
‘ইলন মাস্ক ফেব্রুয়ারিতে এক্সে একটি পোস্ট করেছিলেন, যেখানে কিছু রিপাবলিকান অভিযোগ করেন, ভিওএ এবং অন্যান্য সরকারিভাবে অর্থায়িত মিডিয়া আউটলেটগুলো রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট।’ নতুন পদক্ষেপ সে কারণে বলেও অনেকে অনুমান করতে পারেন।
ভিওএর কার্যক্রম হঠাৎ স্থগিত করার ফলে মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক সম্প্রচারের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারে এর ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে অংশীদার এবং পর্যবেক্ষকরা উভয়ই এই কাটছাঁটের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, ভিওএ পরিচালক পদে তার পছন্দ হবেন কারি লেক। লেক সেসব সাংবাদিকদের জেলে ঢোকানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাদের রিপোর্টিংকে তিনি ‘মিথ্যা’ বলেছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভিওএর মূল সংস্থার পাশাপাশি দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স এবং এএফপির সাথে চুক্তি বাতিলের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরে এই ঘোষণা আসে। ভিওএর কিছু স্থানীয়-ভাষার রেডিও স্টেশন সংবাদ প্রতিবেদন সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে।
ভয়েস অব আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের অর্থায়ন করা আন্তর্জাতিক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম। ভিওএ বিভিন্ন ভাষায় ডিজিটাল, টিভি ও রেডিও বিষয়বস্তু তৈরি এবং সারা বিশ্বের অনুমোদিত স্টেশনগুলোতে বিতরণ/সম্প্রচার করেছে। এর লক্ষ্যবস্তু ও প্রাথমিক শ্রোতারা ছিল মার্কিন সীমানার বাইরে অ-আমেরিকান। নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এর রিপোর্টিং সমস্ত প্ল্যাটফর্মজুড়ে প্রতি সপ্তাহে ৩২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
ইলন মাস্ক সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টুইটার অধিগ্রহণ করার পর, ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর প্রধান টুইটার অ্যাকাউন্টটিকে ‘মার্কিন রাষ্ট্র-অধিভুক্ত মিডিয়া’ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। এটি ছিল এমন একটি লেবেল সাধারণত বিদেশী মিডিয়া আউটলেটগুলোর জন্য সংরক্ষিত যেটি রাশিয়ার আরটি এবং চীনের সিনহুয়ার মতো সরাসরি তাদের নিজ নিজ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে। কিছু দিন পর, টুইটার এনপিআরের অ্যাকাউন্টের নাম পরিবর্তন করে ‘রাষ্ট্র-অধিভুক্ত’ থেকে ‘সরকারি-অর্থায়নে’ করা হয়।
রাষ্ট্রপতির আদেশ, ‘কন্টিনিউয়িং দ্য রিডাকশন অব ফেডারেল ব্যুরোক্র্যাসি’ শিরোনামে, ইউএস এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়ার পাশাপাশি উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং ইনস্টিটিউট অব মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি সার্ভিসেসকে লক্ষ্য করা হয়। একটি নির্দলীয় গবেষণা কেন্দ্র উইলসন সেন্টার বন্ধ করার ফলে রাষ্ট্রের নীতি বিশ্লেষণ কমে যেতে পারে এবং জটিল বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে গবেষণা ও কথোপকথন বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা মার্কিন নীতি সিদ্ধান্তের গুণমানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সমালোচনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না ট্রাম্প
প্যারিস-ভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। সংস্থার মহাপরিচালক থিবাউট ব্রুটিন বলেছেন, এটি ‘বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরূপ এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ সমর্থন করার ক্ষেত্রে আমেরিকার ৮০ বছরের ইতিহাসকে অস্বীকার করে।’
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের সভাপতি মাইক বালসামোও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভিওএয় কাটছাঁট একটি মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রতি আমেরিকার প্রতিশ্রুতিকে ক্ষুণ্ন্ন করেছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, অ্যাসোসিয়েশন ফর ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং ট্রাম্প প্রশাসনকে ভয়েস অব আমেরিকা এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি গণতন্ত্রপন্থী সংবাদমাধ্যমের ফেডারেল তহবিল হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে, সতর্ক করে দিয়েছে যে এটি বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনকে উৎসাহিত করবে।
এসব সমালোচনায় ট্রাম্প প্রশাসন খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না।
আমেরিকা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে!
সবার আগে আমেরিকা স্লোগানটি এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। এ স্লোগান উগ্র আমেরিকান জাতীয়তাবাদ আর সেই সাথে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে জাগিয়ে তুলেছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনের শুরুতে এসে তিনি কিভাবে এই নীতির বাস্তবায়ন করবেন তার কিছু নমুনা বোঝা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী একক পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে হার্র্ড পাওয়ার ও সফট পাওয়ার দু’টি টুলসই ব্যবহার করত। উদার অভিবাসন ও শিক্ষানীতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল মেধা যুক্তরাষ্ট্রে টানার একটি প্রক্রিয়া ছিল। সে সাথে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা (পড়ুন প্রয়োজনে শাসন পরিবর্তন) করে আমেরিকান প্রভাব বাড়াতে ভয়েস অব আমেরিকা ও তার সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখত। কর রেয়াত ও বাজারসুবিধা দিয়ে মিত্র দেশগুলোর অর্থনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিত। এর পাশাপাশি ন্যাটো ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তার নিরাপত্তা ছাতা বিস্তার করে একটি প্রভাববলয় নির্মাণ করেছিল আমেরিকা।
ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত এ ব্যবস্থাটি পাল্টে দিয়ে সব ক্ষেত্রে লেনদেনভিত্তিক প্রত্যক্ষ ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির বিবেচনা সামনে নিয়ে আসতে চাইছে। গত শতকের তিরিশের দশকের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান বিচ্ছিন্নতার একটি আত্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরালো হয়ে ওঠে। তখন আমেরিকা বাকি বিশ্ব থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমেরিকা সে পর্ব থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের যুগে প্রবেশ করে। এক শতাব্দী পর ট্রাম্পের নীতি আমেরিকাকে আবার আত্মকেন্দ্রিকতার যুগে ফিরিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হয়। মিত্র দেশ দখলে নেয়ার কথা বলা, ইউরোপসহ ঐতিহ্যগত মিত্রদের প্রতি শত্রুতা, ন্যাটোকে গুটিয়ে আনার চিন্তা এবং সবশেষে সফটপাওয়ারগুলো বন্ধ করে দিয়ে ট্রাম্প বিচ্ছিন্ন আমেরিকা গড়ার পথে এগোচ্ছেন বলে মনে হয়।
কানাডাকে প্রদেশ বানানো, গ্রিনল্যান্ড দখল বা পানামা ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মতো ট্রাম্পের ভয়ঙ্কর আরেক মন্তব্য হলো ‘ইসলাম হেইটস আস’। একই সাথে তিনি গাজাকে নরক করা এবং ফিলিস্তিনিদের কঙ্গো পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছেন। এখন ইয়েমেনে বোমা বর্ষণ করছেন। ট্রাম্প আমেরিকাকে কতদূর পর্যন্ত নেন বা নিতে পারেন তা দেখার জন্য বিশ্ববাসীকে অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক নয়া দিগন্ত
Discussion about this post