সিরাজউদ্দৌলা নবাবী অর্জন করার পর থেকেই তিনি বিরোধীতার সম্মুখীন হন। এই বিরোধীতা এসেছে তার আত্মীয়-স্বজন যারা মসনদের দাবীদার ছিলো। সেই বিরোধীতা ক্রমেই ষড়যন্ত্রে রূপ নেয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্রাহ্মন্যবাদী হিন্দু ও আধিপত্যবাদী ইংরেজরা। বাংলাসহ এই উপমহাদেশে রাজনৈতিকভাবে ইংরেজ শাসন চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ শুরু হয় পলাশী যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। যে গোষ্ঠি এসেছিল এদেশে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, তারা হত্যা করল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে।
পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ ছিল, কিছু ছিল প্রত্যক্ষ কারণ আবার কিছু ছিল পরোক্ষ। পরোক্ষ কারণের প্রধান ছিল আলীবর্দী খানের প্রতি তাঁর নিকটাত্মীয়দের ঈর্ষাপরায়নতা। পুত্রহীন আলীবর্দী খানের দুই জামাতার মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকার শাসনকর্তা, তারা আশা করেছিলেন আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে তারা মসনদের উত্তরাধিকারী হবেন। কিন্তু সিরাজকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেয়ার তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় এবং তা অবশেষে শত্রুতায় পরিণত হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান শত্রু ছিল তাঁর খালাত ভাই পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ। সিরাজউদ্দৌলার অপর শত্রু ছিল তার খালা মেহেরুন নেসা। মেহেরুন নেসা ওরফে ঘসেটি বেগম ছিলেন অপুত্রক। তিনি সিরাজ উদ্দৌলার ছোট ভাই ইকরামুদ্দৌলাকে লালন পালন করেন। ঘসেটি বেগমের ইচ্ছা ছিল নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে ইকরামুদ্দৌলাকে মসনদে বসাবেন। কিন্তু ইকরামুদ্দৌলা অকালে মৃত্যু বরণ করেন। ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে পড়েন। এক সময় ঘসেটি বেগম শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলার আরেক শত্রু ছিলেন মীর জাফর আলী খান। তিনি আলীবর্দী খানের বৈমাত্রেয় বোন শাহ খানমকে বিয়ে করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান। মীর জাফর আলী খান ছিলেন অত্যন্ত লোভী ও অকৃতজ্ঞ। মীর জাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি হয়ে নবাব সিরাজের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠেন। ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সাথে যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্যতিব্যস্ত তখন মীর জাফর ইংরেজ কোম্পানীর সাথে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা খালা ঘসেটি বেগমকে তার প্রাসাদ থেকে নিজ প্রাসাদ মনসুর গঞ্জে নিয়ে আসেন। এসময় সিরাজ মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি থেকে সরিয়ে মীর মদনকে ঐ পদে নিয়োগ প্রদান করেন। পরে তিনি অবশ্য মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন। কিন্তু মীর জাফর আগে থেকেই নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, এই ঘটনা অসন্তুষ্টি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ সময় মুর্শিদাবাদে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘনিভূত হয়ে ওঠে। সিরাজের প্রতি নাখোশ জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ঊমিচাঁদ প্রমুখ হিন্দু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে তদস্থলে ইয়ার লতীফকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্র করে। আলীবর্দী খানের হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বীজ বপনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দু কর্মকর্তাদের নিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এ সময় যারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে জানকী রাম, দুর্লভ রাম, রাম নারায়ন, কিরাত চাঁদ, বিরু দত্ত, গোকুল চাঁদ, উমিচাঁদ রায় এবং রাম রাম সিংহের নাম উল্লেখযোগ্য।
সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে হিন্দু কর্মকর্তা অধিক সংখ্যায় নিয়োগ পান। এভাবে আলীবর্দী খানের শাসনামলে হিন্দুরা সকল ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এর পরিণতি হয়েছিল অত্যন্ত অশুভ। নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে বাংলার মুসলিম রাজত্বের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সিরাজউদ্দৌলাও তাঁর নানার মতই হিন্দুদেরকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। তিনি মোহনলাল নামক এক কাশ্মিরী হিন্দুকে উচ্চপদে নিয়োগ দেন। মোহন লাল সিরাজের উপরে প্রভাব বিস্তার করে নবাবের প্রধান উজিরে পরিণত হন। আর এসব হিন্দুরাই নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করে। নবাব সিরাজের হাতে কলকাতা পতনের পর যদি উমিচাঁদ নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ মানিক চাঁদ প্রমুখ হিন্দুগণ গভর্ণর ড্রেক ও তার লোকজনকে সাহায্য না করতো তা হলে ইংরেজদের জন্য আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
উনত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলী নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিক চাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লিখে তাতে বলা হয়, নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হতে আসিনি তার কাছে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট। মানিক চাঁদ পত্রখানি নবাবকে দিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। হয়তো দেয়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিক চাঁদ সর্বদা নবাবকে বিভ্রান্ত রেখেছে। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইব ৩১ ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১লা জানুয়ারী, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারতো। সে তার কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ ইংরেজদের দ্বারা তার এবং তার জাতির অভিলাষ পূর্ণ হতে দেখে সে আনন্দলাভই করছিল। এমনকি এ সকল স্থান ইংরেজ-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
ইংরেজদের হাতে বলতে গেলে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তুলে দিয়ে সে হুগলী গমন করে এবং হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাইভ হুগলীতে তার নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানায় যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু’দিন পর হুগলী আক্রমণ করে ক্লাইভ সহজেই তা হস্তগত করে। ইংরেজ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিক চাঁদ নবাবকে জানায় যে, ইংরেজদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলী অধিকারের পর ইংরেজ সৈন্যগণ সমগ্র শহরে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
হুগলীর পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়া মাত্র সিরাজদ্দৌলা বিরাট বাহিনীসহ ২০ জানুয়ারী হুগলীর উপকন্ঠে হাজির হন। ইংরেজগণ তখন হুগলী থেকে পালিয়ে কোলকাতায় চলে যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে তাদের সাথে সন্ধি করেন। ৯ ফেব্রুয়ারী নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা আলী নগরের সন্ধি বলে পরিচিত। এ সন্ধি অনুযায়ী ১৭১৭ সালের ফরমান মুতাবেক সকল গ্রাম ইংরেজদেরকে ফেরত দিতে হবে। তাদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তারা কোলকাতা অধিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তারা একটা নিজস্ব টাকশাল নির্মাণ করতে পারবে।
সিরাজদ্দৌলাকে এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার কারণ হলো মানিক চাঁদের মতো তার অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা। অপরদিকে ক্লাইভের নিকটে এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র। ইংরেজরা একইসাথে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসীদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এতদুদ্দেশ্যে ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজদ্দৌলার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্যে যে, তারা ফরাসী অধিকৃত শহর চন্দরনগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্যে নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাদের এক বিরাট রণকৌশল। নবাব ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি বিদেশী বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কি করে ভংগ করতে পারেন?
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ইংরেজদের সাহায্য না করলে তারা এটাকে তাদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসীদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। তদনুযায়ী তিনি সেনাপতি নন্দনকুমারকে নির্দেশ দেন যে, ইংরেজরা যদি চন্দরনগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসীদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসীরা যদি ইংরেজদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ইংরেজদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ দশ-বারো হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে একই পন্থায় নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজদ্দৌলা কোন বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু হিন্দু শেঠ ও বেনিয়াগণ এবং তাঁর নিমকহারাম কর্মচারীগণ, যারা মনেপ্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, সিরাজদ্দৌলাকে হরহামেশা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা বলে যে, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী মুর্শিদাবাদ থেকে সেদিকে প্রেরণ করার কুপরামর্শ দেয়। এভাবে ইংরেজদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেয়া হয়।
ইতোমধ্যে ৫ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কোলকাতা এসে পৌঁছায়। ৮ মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। নবাব রায়দুর্লভ রাম এবং মীর জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দরনগর অভিমুখে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের পৌঁছাবার পূর্বেই ফরাসীগণ আত্মসমর্পণ করে বসে। তারা চন্দরনগর ছেড়ে যেতে এবং বাংলায় অবস্থিত তাদের সকল কারখানা এডমিরাল ওয়াটসন এবং নবাবের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজী হয়। অতঃপর বাংলার ভূখন্ড থেকে ফরাসীদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে ক্লাইভ নবাবের কাছে দাবী জানায়। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসীদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে কোম্পানীর দু’হাজার সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। এতে ফরাসীদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি অভিযোগ আরোপ করা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩শে এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলীনগরের চুক্তি ভংগ করেছেন।
নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পাকাপোক্ত ষড়যন্ত্র করে, সিরাজেরই তথাকথিত আপন লোক রায়দুর্লভ রাম, উমিচাদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে। তাদেরই পরামর্শে মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যেও সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। শুধু উমিচাঁদ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে। সে নবাবের যাবতীয় ধন-সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবী করে বসে। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশী করার জন্যে ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরী করে। মীর জাফরের সংগে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলীনগরের চুক্তির সকল শর্ত পুরাপুরি পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানীকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনিয়ানদেরকে সাত লক্ষ টাকা। কোলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমুদয় এলাকা চিরদিনের জন্যে কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হবে।
এতসব ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে ব্যর্থ হয় সিরাজউদ্দৌলা। সে মীর জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন যদি তারা ফরাসীদের অনুসরণে উত্তরদিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের সম্মুখীন হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ রাম প্রভৃতির উপর। তারা চরম মুহুর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। এরপরেও মীর মদন বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু ইংরেজদের গুলিতে নিহত হয়ে গেলেন। এই সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তখনও যুদ্ধের গতি নবাবের পক্ষে ছিল। মীর মদনের সাথে মোহনলাল ও সিনফ্রে ইংরেজদের রপ্ত করে ফেলেছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে মীর জাফর যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দেন। রায়দুর্লভের কুপরামর্শে ও চাপে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাতে বাধ্য হলেন।
পরক্ষণে ইংরেজদের দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে অবশেষে নবাবের সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হয় এবং নবাব পালিয়ে যান। কিন্তু পথিমধ্যে মীর জাফরপুত্র মীরন তাকে হত্যা করে। এভাবে পলাশীর বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাত হয়। আর এভাবেই বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, যা উদিত হতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ২০০টি বছর।
পলাশী যুদ্ধের ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হয়
এক. বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সংগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
দুই. ইংরেজগণ হিন্দু প্রধানদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যে হিন্দুদের পুরাপুরি ব্যবহার করে।
তিন. নবাবের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা প্রায় সকলেই ছিলো তার প্রতি নাখোশ এবং তাদের উপরই সিরাজকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হতো। যাদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তারাই তার পতনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলো।
চার. পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। এ ছিল যুদ্ধের প্রহসন। ইংরেজদের চেয়ে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেকগুণ বেশী। নবাবের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ করলে ইংরেজ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো এবং ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। অথবা সিরাজদ্দৌলা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাকে হয়তো পরাজয়বরণ করতে হতো না।
Discussion about this post