বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত রোববার একটি প্রোগ্রামে আলোচনা করতে গিয়ে জামায়াত-শিবির নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, জামায়াত যে কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে সেটা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। আর ছাত্রশিবিরেরও স্টাডি সেল আছে। তারা পড়ালেখা করে।
জামায়াতকে নিয়ে দেয়া মির্জা ফখরুলের এসব কথায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের শরীরে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। তিনি মির্জা ফখরুলের উপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। এ নিয়ে সোমবার কাদের একটি বিবৃতিও দিয়েছেন।
বিবৃতিতে তিনি জামায়াত সম্পর্কে বলেছেন, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী-স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য অযৌক্তিক ও দ্বিচারিতাপূর্ণ। জামায়াতের রাজনীতি বাংলাদেশের মূল চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বাধীনতার মূল্যবোধের পরিপন্থি। রাজনীতির এ ধারা বার বার দেশবিরোধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক কখনোই ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের আখরে রচিত পবিত্র সংবিধান ও রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনাবিরোধী এই রাজনীতিকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে পারে না। যাদের রাজনীতি দেশের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে তাদের কৌশলও কখনো বিজ্ঞানসম্মত বা যৌক্তিক হতে পারে না।
জামায়াতকে নিয়ে ওবায়দুল কাদের যা বলেছেন এগুলো নতুন কিছু না। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা প্রতিটি সভা-সমাবেশে জামায়াতকে গালি দিয়ে আসছে। জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে গালি না দিলে তাদের পেটের ভাতই হজম হয়না। জামায়াতকে গালি দেয়া তাদের পুরনো অভ্যাস।
প্রশ্ন হল-বিএনপি মহাসচিব জামায়াতের পক্ষে কথা বলায় কাদেরের গায়ে জ্বালা ধরে গেছে। জামায়াত নিয়ে তাদের অন্তরে এত জ্বালা কেন? যেদিন জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছিল সেদিন এই জ্বালা কোথায় ছিল? শেখ যেদিন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সাথে বসে সংবাদ সম্মেলনে করেছিল-সেদিন এই জ্বালা কোথায় ছিল? আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরী যখন জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের কাছে এসে সমর্থন চেয়েছিল-সেদিন এই জ্বালা কোথায় ছিল?
ইতিহাস বলছে, তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীই প্রথম রাজপথে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। বিএনপি সরকারের আচরণ দেখেই জামায়াত মনে করছিল যে আগামীতে বিএনপির অধীনে সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এ লক্ষ্যে জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা পেশ করেছিলেন।
তখন প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগও জামায়াতের এই কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা সমর্থন করেছিল। জামায়াতের দেয়া এই ফর্মূলা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তখন জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর সরকার পতনের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে জামায়াতের অবদানই ছিল বেশি। আওয়ামী লীগ-জামায়াতের আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতনের পর ১২ জুন আবার সব দলের অংশগ্রহণে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পরই আওয়ামী লীগের পুরনো চেহারা প্রকাশিত হতে থাকে। শুরু হয় জামায়াতের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন। দিন যত যায় সরকারের নির্যাতনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে মিলে যখন জামায়াত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে তখনই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।
তারপর ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সহযোগিতায় সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা গ্রহণ করেই তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে বিতর্কিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলে। হত্যা-ধর্ষণের কথিত অভিযোগে গ্রেফতার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে। সাজানো বিচারের মাধ্যমে একে একে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
রাজিৈনতক বিশ্লেষকরাও বলছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গ ত্যাগ করে বিএনপির সাথে জোট করার কারণেই তারা জামায়াতকে স্বাধীনতা বিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী বলে। আর জামায়াত যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গ ত্যাগ না করতো, শেখ হাসিনার অপশাসনের বিরুদ্ধে মাঠে না নামতো তাহলে জামায়াত নেতারাও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেতেন। আর ওবায়দুল কাদেরদের আসল জ্বালা হল জামায়াত তাদেরকে ত্যাগ করে বিএনপির সাথে জোট বাধা।
Discussion about this post