মঈন খান
না, আমার আর ১০ টাকায় চাল খাওয়ার শখ নেই। নেই বিনা পয়সায় সার কিংবা ঘরে ঘরে চাকরির দাবি। ওসবের খায়েশ খুব ভালোভাবেই মিটে গেছে। এখন আর দেশের মানুষ ওসব অলীক কল্পনা করে সময় নষ্ট করতে প্রস্তুত নয়। রাজনীতির ময়দান যখন শূন্য, তখন এসব কথা বলেও লাভ নেই, ভেবেও লাভ নেই। মানুষ তার নিজের ভাগ্য গড়তেই আপাতত বেশী মনযোগী হয়ে উঠেছে। এটাও অবশ্য উন্নয়নের লক্ষণ। গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক, জোর জবরদস্তি করে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের নামে ডাকাতি করে হলেও এ উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। আর যাইহোক, লুটপাটের এ মহাসড়ক থেকে আপাতত ফিরে আসার কোনই সুযোগ নেই। এখন আসল কথায় আসা যাক।
বিগত চার দলীয় জোট সরকারের যতগুলো জনবান্ধব সিদ্ধান্ত ছিল তার অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল পলিথিন নিষিদ্ধকরন। ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধের পর বেশ কয়েক বছর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সাম্প্রতিক কয়েক বছরে পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে বেড়েছে পলিথিনের বিক্রি। রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত পরিবেশ বিধ্বংসী এই পলিথিনের ব্যবহার। অথচ পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর আইন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। প্রশ্ন থেকে যায় যে, পলিথিন নিষিদ্ধ করে যে আইন করা হয়েছিল সে আইনটি কি বিলুপ্ত করা হয়েছে? যদি তা না হয় তবে কিভাবে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে দেদারছে চলছে পলিথিনের ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণ?
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় জনবহুল শহরগুলোতে জলাবদ্ধতা এখন এক বড় আতঙ্কের নাম। সূলভমূল্যে এবং কখনও বিনামূল্যে জনগণের হাতে আসা এসব পলিথিন যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় জমা হচ্ছে ড্রেনে, জলাশয়ে বা নালা নর্দমায়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। যে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেষে গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা, সে বুড়িগঙ্গা আজ পলিথিনের ভয়াল থাবায় ওষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে বয়ে চলেছে। তাছাড়া নিয়ন্ত্রনহীন পলিথিনের অবাধ অযাচিত ব্যবহার আগামীর প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। প্রায় আঠারো কোটি মানুষের এই জনবহুল দেশ এখনো পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য রক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ মরণঘাতি রোগ উৎপাদনকারী পলিথিনের বিপণন ও ব্যবহার আইন করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। অথবা আইন প্রয়োগ করার মত দায়িত্বশীল কারো দেখা মিলছে না! রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর নিষিদ্ধ এই পলিথিন ব্যাগে বাজার সয়লাব। প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহরেই গড়ে এক কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যাবহৃত হয়। যার মধ্যে ৯০ লক্ষ ব্যাগই প্রতিদিন একবার ব্যবহারের পরই নিক্ষিপ্ত হয় ।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিনের কারণে পুরুষের টেস্টোস্টেরন এবং নারীর ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোন উৎপাদন কমে যায়। এর ফলে কমছে মানুষের যৌনক্ষমতা। বাড়ছে বন্ধ্যাত্ব। পলিথিন থেকে সৃষ্ট এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া মরণঘাতি ক্যান্সার ও ত্বকের বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। তাছাড়াও ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগও ছড়ায় অনায়াসে। রঙিন পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এতে ব্যবহৃত ক্যাডমিয়াম শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী একটি পলিথিন ব্যাগ প্রকৃতিতে মিশে যেতে সময় নেয় পাঁচশ’ থেকে হাজার বছর পর্যন্ত। ফলে তা কৃষি জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পলিথিন মাটির নিচে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে না। মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। সার্বিকভাবে দুষিত হয় পরিবেশ।
রাস্তাঘাটে খোলাবাজারে অবাধে চলছে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ও বিপণন অতিসত্ত্বর বন্ধ না করা গেলে এ বছরেই বর্ষা ঋতুতে এর ফলাফল অবলোকন করা যাবে। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাগজ বা কাপড়ের ব্যাগ উৎপাদন বিপণন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে রক্ষা পাবে পরিবেশ। সুস্থ্য হয়ে বেড়ে উঠবে আগামীর প্রজন্ম। কিন্তু এ উদ্যোগ সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন থেকে কি লাভ? যদি তার বাস্তবায়ন না থাকে? আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি জনগণকে পলিথিনের ব্যবহার থেকে ফিরে আসতে জনসচেতনতা তৈরী করা সময়ের দাবি। যে সরকার দেশের রাজনীতি পরোক্ষভাবে হলেও নিষিদ্ধ করে রাখতে পারে, আমার বিশ্বাস সে সরকার প্রাণঘাতি পলিথিনের ব্যবহার প্রত্যক্ষভাবেই নিষিদ্ধ করতে পারবে। প্রয়োজন শুধু একটুখানি সদিচ্ছার। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া না দেয়া আপনাদের বিবেকের কাছেই রেখে দিলাম। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে প্রতিষ্ঠিত বাকশালী স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি দিবেন কিনা তা যথেষ্ট জটিল ব্যাপার। আপাতত দেশের ১৮ কোটি মানুষকে পলিথিন থেকে মুক্তি দিন।
Discussion about this post