অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা শাখার ব্যাক্তিদের সহায়তায় দেশটির সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকে সরকার অবৈধ ও জোরপূর্বক হস্তক্ষেপ করেছে বলে যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিষ্ট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
‘বাংলাদেশের বৃহত্তম ব্যাংকে অবৈধ হস্তক্ষেপ শুরু করলো সরকার’ শিরোনামে গত ৬ এপ্রিল দ্যা ইকোনমিষ্ট পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে তুলে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করাসহ অনেক গোপন ও ভয়ংকর তথ্য উঠে আসে এই প্রতিবেদনে।
ইকোনোমিষ্টের সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করে অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
এটা ছিলো একটি গোয়েন্দা সংস্থার জন্য একেবারেই বেমানান, ৫ জানুয়ারি সকালবেলা তারা ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে ফোন দেয় এবং ঢাকা সেনানিবাসে তাদের সদরদপ্তরে তুলে নিয়ে আসে। এই কর্মকর্তারা ভদ্রভাবেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদত্যাগপত্র দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলে এবং তারা তা করতে বাধ্য হয়। তার কয়েক ঘন্টা পর সেনাদের তত্ত্বাবধানে সেনাদের নিজস্ব হোটেলে বোর্ড মিটিং ডেকে ব্যাংক কর্মকর্তারা তাদের পরিবর্তে যারা দায়িত্ব পালন করবে তাদের নাম ঘোষণা করেন।
ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সরকারের অতি আগ্রহের কারন, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা। ব্যাংকটি দেশের সবচাইতে বড় ব্যাংক এবং এটি ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত। যদিও ব্যাংকটিতে দলটির পুঁজি অনেক কম, কিন্তু কুয়েত ও সৌদিআরবে অবস্থিত শেয়ার হোল্ডাররা দলটিকে ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড নিয়োগের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে।
জামায়াত সমর্থকরা ইসলামের কঠোর অনুসারী, তুলনামুলক উদার বাংলাদেশে যা খুব একটা অনুসরণ করা হয় না। নির্বাচনে তারা কখনোই ১২% এর বেশি ভোট পায়নি। এটা তাদের জন্য একটি বিব্রতকর দিক যে, তারা পাকিস্তান হতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিলো। এবং তাদের ছাত্র সংগঠনও পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলো। ২০১০ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিশেষ কোর্ট তৈরি করে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে। অপরাধী সাব্যস্তদের জেল অথবা মৃত্যুদণ্ড দেয়।
ট্রায়ালটি জামায়াতের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ধর্বংস করতে পারলেও তাদের অর্থনৈতিক খুঁটি ছিলো অক্ষত। ব্যাংকিং খাতের এক তৃতীয়াংশই ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। এর রয়েছে ১২ মিলিয়ন বিনিয়োগকারী, ১২০০০ লোকবল এবং প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন। বিগত বছর বাংলাদেশের মোট ১৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক রেমিটেন্সের এক চতুর্থাংশেরও বেশি লেনদেন হয় ব্যাংকটির মাধ্যমে। ব্যাংকটি অনেক সুদূরপ্রসারী নীতি ব্যবহার করে বলে ধরা যায়।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বড় ভয় হচ্ছে, ব্যাংকের সম্পদগুলো জামায়াতের পুনরুত্থানে ব্যবহৃত হতে পারে। জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত দাতব্য সংস্থা ইবনে সিনা ট্রাষ্টও ব্যাংকটির শেয়ার হোল্ডার, যাতে প্রায় ৬০০০ জনশক্তি নিয়োজিত আছে। সংস্থাটি ১৯টি হাসপাতাল, অনেকগুলো স্কুল এবং কিছু পেশাদার কলেজ পরিচালনা করে। ব্যাংকটির একটি নিজস্ব দাতব্য শাখাও রয়েছে, যার পরিচালকদেরকেও জানুয়ারিতে পরিবর্তন করা হয়েছিলো।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী চট্টগ্রামের বহুমাত্রিক কোম্পানি এস আলম গ্রুপের সাথে ব্যাংকটি সম্পর্ক তৈরি করে এবং বিনিয়োগ করে। এই গ্রুপের মালিকানাধীন অন্য ব্যাংক হতে উপরস্থ কর্মকর্তাকে ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে দেশের একজন দক্ষ আমলা হিসেবেই গণ্য করা হয়, যদিও সম্প্রতি তিনি ব্যাংকিং খাত হতে অবসর গ্রহন করেছিলেন। তিনি ব্যাংকের এই পরিবর্তন সম্পর্কে কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু ভাইস চেয়ারম্যান এহসানুল আলম বলেন, ব্যাংকের এই প্রশাসন রাজনৈতিক ঋণের দ্বার উন্মোচন করতে পারে। অন্য একজন বোর্ড সদস্য বলেন, ঋণের ভোক্তা ও ঋণ প্রদানের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে, বেশিরভাগ ঋণই চট্টগ্রামের লোকেরা পাচ্ছে। ঋণ প্রদান বিষয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পরিচালনা পর্ষদকে সতর্ক করেছে।
সৌদিআরব ও কুয়েতের শেয়ার হোল্ডারদের পরিচালনা পর্ষদে হস্তক্ষেপ জনিত বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়। এবং তারা এ বিষয়ে তীব্রভাবে অভিযোগ করেন। যার একটি হচ্ছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক(আইডিবি), তারা উল্লেখ করে যে জানুয়ারিতে মাত্র তিন দিনের নোটিশে বোর্ড মিটিং করা হয়, যার ফলে সেখানে কোনো প্রতিনিধি পাঠানো সম্ভব হয়নি। তারা এই পরিবর্তনের পেছনে যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং অভিযোগ করেন যে নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগে কোনো নিয়োগ প্রক্রিয় অনুসরণ করা হয়নি। বিদেশি শেয়ার হোল্ডাররা পরিবর্তনকে অনুমোদন দিতে গিয়ে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তাদের অজ্ঞাতেই নেয়া হয়েছে যা সরকারের একটি বড় ত্রুটি। সরকার তাদের এ ব্যপারে আশ্বস্ত করে যে ব্যাংকটি রাজনৈতিক হরিলুটের শিকার হবে না।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামী লীগ ভয়ানক একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতি জঙ্গি হামলার পর পশ্চিমা কুননৈতিকরা খুব ভীত হয়ে পড়েছেন। বিরোধীদল নিপীড়নের ফলে দেশটির সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে এই সরকারের অধীনে একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন হবে এটা কোনো ব্যক্তিই আশা করে না। বরং সবার মাঝে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রীত্ব টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার তার সব চেষ্টাই করবে। যেমন অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক কর্তাদের সাথে।
ইকোনোমিষ্টের প্রতিবেদনটির লিংক: The government initiates a coup at Bangladesh’s biggest bank
ভাষান্তর: অ্যানালাইসিস বিডি
Discussion about this post