ওমর আলনাতুর
কল্পনা করুন, আপনার ঘুম ভাঙলো স্ত্রীর চেঁচামেচিতে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে আপনাকে এ জন্য দায়ী করছেন তিনি। বৃষ্টিকে দু’চোখে দেখতে পারেন না আপনার স্ত্রী। তাই বলছেন, আপনার কারণেই তার দিনটাই মাটি হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই ছেলেমেয়েরা আপনাকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল। কারণ ওরা টোস্টারটা ভেঙে ফেলেছে। ফলে এখন ছোট কেক বানানো যাচ্ছে না। ছেলেমেয়েরা মনে করে, এ জন্য দায়ী আপনিই। কাজে যাওয়ার পথে থামলেন গ্যাস স্টেশনে। সেখানে সবাই আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে। এর কারণ, গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে। এরপর আপনি কর্মস্থলে পৌঁছে দেখলেন, সহকর্মী সবাই আপনাকে ঘিরে ধরে দাবি জানাচ্ছে, অফিসের প্রিন্টারটা জ্যাম হয়ে গেছে; অতএব আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পেলেন, সবাই আপনার বিরুদ্ধে সজোরে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কারণ রাস্তায় অসম্ভব ট্রাফিক জ্যামে তারা দিশাহারা।
এসব কিছু হাস্যকর ব্যাপার নয় কি? যেসব বিষয়ের ওপর আপনার বিন্দুমাত্রও নিয়ন্ত্রণ নেই, সব সময়ে সেগুলোর জন্য আপনাকেই দায়ী করা হচ্ছে- এমন দৃশ্য কি কল্পনা করতে পারেন? এসব ব্যাপারে সর্বদাই আপনাকে বলা হচ্ছে মাফ চাইতে- এমনটা কি ধারণা করা যায়? আপনি মাফ চান বা না চান, আপনাকে ঘৃণা করার কথা কি ভাবতে পারেন? আজকের আমেরিকায় মুসলমান হওয়ার অনুভূতি ঠিক এমনই।
আমি একজন গর্বিত আমেরিকান; বড় হয়েছি টেক্সাসে। কলেজে পড়ি; সেই সাথে একজন মানবতাবাদী। আমার আকাঙ্খা ডাক্তার হওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রে সেই সাথে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে যাতে সবাই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন সে জন্য বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনার যারা প্রত্যাশা করে, আমি নিজে তাদের একজন। আমি একজন মুসলিমও। আমি সেই ১৬০ কোটি মানুষের অন্যতম, সন্ত্রাসী কোনো ঘটনা ঘটলেই যাদের দায়ী করা হয়। আমরা যেন ‘মুসলিম’ নামের একটি শব্দমাত্র। যারা নিজেদের জঘন্য অপরাধগুলোর পক্ষে অজুহাত হিসেবে আমাদের ধর্মকে ব্যবহার করছে, ওরা ‘মুসলিম’ কথাটা ছিনতাই করেছে। আমেরিকার মুসলমানরা কমিউনিটি ও জাতির উন্নতির লক্ষ্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তবুও সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানাতে এবং এ জন্য ক্ষমা চাইতে বারবার বলা হয় আমাদের। এটা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কারণ সন্ত্রাসের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই।
এখানে পাঁচটি কারণ তুলে ধরছি, সন্ত্রাসের জন্য মুসলমানদের কখনো মাফ চাওয়া যে উচিত হবে না, এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে :
১. ক্ষমা চাইতে বলাটা অবাস্তব। আমি ধর্মের নিয়মকানুন মেনে চলি। জানি, আমার ধর্ম শান্তির আদর্শ শিক্ষা দেয়। এ ব্যাপারে আমি এতটাই নিশ্চিত যে, কেউ যদি আল কুরআনের একটা আয়াতও দেখাতে পারেন যেখানে নিরপরাধ মানুষ হত্যা কিংবা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সমর্থন করা হয়েছে, তাকে আমি ১০ হাজার ডলার পুরস্কার দেবো। এটা আমার উন্মুক্ত প্রস্তাব যার মেয়াদ কোনো দিন শেষ হবে না। ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদী নয়; এটা বাস্তব তথ্য দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছি। আরো দেখিয়েছি, একজন মুসলমানের হাতে নিহত হওয়ার চেয়ে আপনার বেশি আশঙ্কা রয়েছে বজ্রপাতে মৃত্যু, গাড়িচাপা পড়ে পিষ্ট হওয়া এবং একটা ছোট্ট শিশুর হাতে মারা পড়ার। তা হলে কেন আমাকে মাফ চাইতে হবে এমন কোনো সহিংসতার জন্য, যার সাথে আমার বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। আমার ধর্ম সহিংস কর্মকাণ্ডের তীব্র বিরোধী।
নিজেকেই প্রশ্ন করুন, মাতাল ড্রাইভার কার চালিয়ে মানুষ মেরে ফেললে গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানির কি ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত? আপনার ভাই অতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালিয়ে অভিযুক্ত হলো। তার নামের সাথে আপনার কিছুটা মিল আছে। এ জন্য কি আপনাকে পুলিশের কাছে মাফ চাইতে হবে? আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে যখনই কারো প্রাণহানি ঘটে তখন কি দেশটার বন্দুকমালিকদের এ জন্য ক্ষমা চাইতে হয়? দিনটা মেঘলা হলে সে জন্য কি আবহাওয়া বিভাগ দায়ী? আপনার অ্যালার্জির সমস্যা আছে। তা বলে কি ওষুধের দোকানিদের মাফ চাইতে হবে?
আমি একজন লেখক। তা বলে কি অন্য কোনো লেখকের লেখার ধরনের জন্য আমার ক্ষমা ভিক্ষা করা উচিত? যত দিন পর্যন্ত না আপনি কুরআনের তেমন কোনো আয়াত পান যে জন্য ১০ হাজার ডলার দেয়ার কথা ঘোষণা করেছি অথবা আপনি কোনো মুসলমানকে প্রকাশ্যে ও নগ্নভাবে সন্ত্রাসবাদের সমর্থনে বলতে শোনেন, আমাদেরকে এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে বা সামষ্টিকভাবে মাফ চাইতে বলা হাস্যকর উদ্ভট ব্যাপার।
২. এটা স্পষ্ট যে, মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করে আসছে। এটা বুঝার জন্য একটা সহজ কাজ করলেই চলে। তা হলো, যেকোনো সন্ত্রাসবাদী হামলার ব্যাপারে গুগলে সার্চ করুন। সেখানে দেখবেন, বহু মুসলমান প্রকাশ্যে নিন্দা জানাচ্ছে সন্ত্রাসের। যেমন প্যারিসে শার্লি এবদো পত্রিকা অফিসে হামলার নিন্দা করেছে মুসলমানরা যার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মুসলমানরা প্যারিসে হামলার নিন্দা করেছে সারা বিশ্ব থেকে। সব সময়েই তারা এটা করে থাকে। এর সত্যতা অনস্বীকার্য। আকাশটা নীল, এ কথা প্রতিদিন সকালে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তেমনি, যতবার সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে ততবারই মুসলমানরা আপনাদের এই নিশ্চয়তা দেয়া অনাবশ্যক যে, ‘আমরা এখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।’ আপনার যদি আজো বিশ্বাস হয় না যে মুসলমানরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তাহলে বলতে হয়, তারা যতবার ক্ষমা প্রার্থনা করুক কিংবা সন্ত্রাসের নিন্দার ভাঙা রেকর্ডটা যত বাজানো হোক না কেন, মুসলিম জনগোষ্ঠী বা তাদের সংগঠনগুলোর প্রতি আপনার অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার অবসান হবে না।
৩. সন্ত্রাসবাদ দমনের অভিযানে মুসলমানরা একদম সামনের সারিতে। এ ব্যাপারে কোনো লোকের কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও তাকে এ জন্য মাফ চাইতে বলাটা হাস্যকর বিষয়। এর চেয়ে উদ্ভট একটা ব্যাপার হলো মানুষকে সে কাজের জন্য মাফ চাইতে বলা, যে কাজের বিরুদ্ধে তারা কঠিন পরিশ্রম করছে।
মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে চায় ততটা, যতটা চায় অন্য যেকোনো আমেরিকান। এ কারণে আমাদের মাঝে আছেন নীলুফার রহমানী আর কুবরা খাদেমীর মতো মুসলিম নারী যারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ছেন একেবারে সামনে থেকে। কয়েক মিলিয়ন মুসলিম যুবক আইএস-এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মুসলমানদের সংগঠনগুলো আর স্কলাররা বারবার বিবৃতি দিয়ে আইএস-এর নিন্দা করেছেন। এ কারণে তাদের অনেকের শিরñেদ করা হয়েছে।
সারা বিশ্বের ১২০ জন মুসলিম স্কলার আইএসকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। এতে তারা ইসলামের আলোকে দেখিয়েছেন, আইএস ইসলামের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত। এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী খ্রিষ্টানদের ওপর নির্যাতন চালানোর প্রতিবাদ করায় তারা মুসলিমদের হত্যা করছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে দমকল বাহিনী মাফ চায় না। কারো হৃদরোগ হলে সে জন্য ডাক্তারকে মাফ চাইতে হয় না। একই কারণে এটা আশা করা উচিত নয় যে, মুসলমানরা সে কাজের জন্য মাফ চাইবে, তারা নিজেরা যে কাজের বিরুদ্ধে প্রয়াস চালাচ্ছে।
৪. মুসলমানরাই সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বেশি শিকার। ওয়েস্টপয়েন্টে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি একাডেমি অবস্থিত। সেখানকার কাউন্টার টেররিজম সেন্টার হিসাব করে দেখেছে, আলকায়েদা অমুসলিমদের চেয়ে সাতগুণেরও বেশি হত্যা করছে মুসলমানদের। জাতিসঙ্ঘের মতে, আইএস-এর সন্ত্রাস-সহিংসতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুসলমানরা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিমত, সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকার হলো, মুসলিম জনগোষ্ঠী। যে দিকেই আপনি তাকান না কেন, দেখা যাবে মুসলিম আর সন্ত্রাসবাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘সম্পর্কটা’ হচ্ছে, তারা সন্ত্রাসের শিকার। এটা মর্মান্তিক পরিহাস যে, তবুও মুসলমানরাই সন্ত্রাসের অভিযোগে সর্বাধিক বিদ্বেষের পাত্র। দাসত্বের জন্য কালো আমেরিকানদের দায়ী করা যেমন ভুল, বিশ্বে ক্ষুধার জন্য অভুক্ত শিশুদের যেমন দায়ী করা যায় না এবং স্কুলে গুলি চালানোর জন্য ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ শিশুদের দায়ী করা যায় না, তেমনি সন্ত্রাসবাদের দায়ে মুসলিমদের অভিযুক্ত করা সমান অন্যায়। বরং তারাই সব সময়ে সন্ত্রাসের বলি।
আপনারা কি চান, আমি আইএস নেতাকে ফোন করে বলি সন্ত্রাস বন্ধ করতে? তাহলে তার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়, সে তথ্য আমাকে দিন। তা হলে আমি তো বটেই, সব মুসলমানই খুশি হবে। তবে প্রথমে মুসলমানদের সাথেই আইএস-এর আলোচনা হওয়া উচিত। তারা আইএস-এর হাতে সর্বাধিক ক্ষতির কবলে পড়েছে। আইএস নেতাকে বলতে হবে, আইএস মুসলমানদের হত্যা করাকে বৈধ হিসেবে দেখানোর জন্য সে ধর্মকে হাইজ্যাক করেছে যার প্রকৃত অনুসারী এই মুসলমানরাই। আইএসকে এটা বন্ধ করতে হবে।
৫. যদি সন্ত্রাসের জন্য মুসলমানদের মাফ চাইতে হয় তাহলে অন্য সবাইকেও তা করতে হবে। এই কথাটার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক আছে, এমন দুর্বৃত্তদের কাজের জন্য ক্ষমা চাইতে এবং তাদের নিন্দা জানাতে বলা হচ্ছে মুসলমানদের। কিন্তু কেন কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা করতে হবে? বিষয়টি সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনার জন্য নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন; শ্বেতাঙ্গরা ২০০ বছরেও কম সময় আগে দাসপ্রথা সমর্থন করত। তাহলে সব শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে কেন এ জন্য মাফ চাইতে বলা হয় না? ওই দাসদের এক-তৃতীয়াংশই ছিল মুসলমান। মিয়ানমারে মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের ওপর সহিংস হামলা চালাচ্ছে। সে জন্য সব বৌদ্ধকে কেন ক্ষমা চাইতে বলা হচ্ছে না? বর্ণবাদী পুলিশ নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন গাছের পাতা ঝরার মতো ঝরিয়ে দিচ্ছে। তবু কেন সব পুলিশকে বলা হয় না ক্ষমা প্রার্থনার জন্য?
আপনাদের একটি কথা বুঝতে হবে। যেসব জঘন্য অপরাধের উল্লেখ এখানে করা হলো সেগুলোর সাথে আপনাদের যেমন সম্পর্ক নেই, তেমনি সন্ত্রাসবাদের সাথেও আমার নেই কোনো প্রকার সম্পর্ক। তবুও অনেকেই আমাকে সন্ত্রাসের জন্য দায়ী করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আমি একজন মুসলিম- এটা ছাড়া আর কোনো কারণ নেই তাদের এই অপচেষ্টার। অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে, আমি সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানাই কি না- এ কথা জানতে চেয়ে আমার মানবতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
লেখক : ফিলিস্তিনি আমেরিকান ছাত্র
ভাষান্তর : মীযানুল করীম (হাফিংটন পোস্টের সৌজন্যে)
নয়াদিগন্তের সৌজন্যে
Discussion about this post