বাংলাদেশে চলে শুধু কপি করার কাজ। নিজস্ব চিন্তা ও পরিকল্পনা এখানে নেই। আমাদের শাসনকার্যও পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজ ও পাকিস্তান আমলে চালু হওয়া রীতিনীতি অনুসরণ করে। তাই আমাদের এখনো মীমাংসায় পৌঁছানো যায় নি কেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবো? বিশবিদ্যালয় রাষ্ট্রের জন্য কী সেবা দিবে তাও এখনো ডিফাইন করা হয়নি।
ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর ন্যায় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত জিজ্ঞাসারাও ঘুরেফিরে সামনে অমীমাংসীতই থেকে যাচ্ছে আমাদের সামনে। অনেকেই মনে করেন, বাজারের সাম্প্রতিক চাহিদা অনুযায়ী ইনোভেশন, বিশেষায়িত গবেষণা প্রকাশনা ও কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ। সে অনুযায়ীই এখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে তুলনামূলক অনেক বেশি বিনিয়োগ করা হচ্ছে বা বিনিয়োগের তাগিদ সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ভিত্তি পাবে।
১৮১০ সালে ভিলহেম ভন হামবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য তিনটি শর্তের কথা লিখলেন। বলে রাখা ভালো, ওই শর্তের ওপর ভিত্তি করেই বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার এক অতুলনীয় সমন্বয় থাকতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে সুনির্দিষ্ট কাঠামোগত ভিত্তি পাবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং
তৃতীয়ত, প্রশাসনিক আঙ্গিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক দেশেই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে। সেদিক বিবেচনায় মৌলিক প্রশ্ন থাকে, সমাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কী হবে? অবদানের দিক থেকে চিন্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত গভীর ও ‘নিবিড়তম ভূমিকা’ বা ডিপার ফাংশনালিটি আছে। সে ব্যাপারে উদাসীন থেকে শুধু স্বল্পমেয়াদি কিছু বৈষয়িক প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে আলোচনার মুখ্য বিষয় করে তুলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিগূঢ় সংস্কৃতিকে যেমন অস্বীকার করছি, তেমনি অমর্যাদাও করছি।
বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, সরকার তার স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করতে আগ্রহী। বেশি বেশি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিক শিক্ষা না দিতে পেরে হয়ে গেছে বেকার উৎপাদন কারখানা। বিশেষায়িত গবেষণা, দক্ষ জনগোষ্ঠী উৎপাদন, ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতা, সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত উন্নতি, চলমান বৈশ্বিক যোগাযোগ ও কূটনীতিতে অবদান রাখার মতো কাজ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হয় না।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে একের পর এক খবরের শিরোনাম হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের চৌর্যবৃত্তি ও যৌন হয়রানির খবর শেষ হতে না হতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে বের হয়ে আসে নিপীড়নের অনেক রকম ইতিহাস। এর মধ্যে এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে বরণ করে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার কর্মচারীদের অদ্ভুত ভঙ্গিতে নৃত্য করার ভিডিও–ও ভাইরাল হয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার খবরও পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক মূল নিউজ হলো ছাত্ররা মারামারি করছে, টেন্ডার দখল করছে। সিট বাণিজ্য ও ভর্তি বাণিজ্য চালাচ্ছে ইত্যাদি। অধিকাংশ শিক্ষকের গবেষণা আদতে কোনো গবেষণাই না। শুধু কপি পেস্ট ও ডিগ্রি হাসিলের কসরত মাত্র। বাংলাদেশে প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই ভিসি হয় তারা তাদের ১৪ গোষ্ঠিকে চাকুরি দেয়। নিজেদের সন্তানদের যোগ্যতা না থাকলেও শিক্ষক বানিয়ে যাচ্ছে। আর এসব ঘটনা মূল কারণ সরকার। মেধা বা গবেষণা নয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে।
এসব ঘটনা যখন চলমান, ঠিক তখনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আবার খবরের শিরোনাম হয়েছে। সেখানে ছাত্ররাজনীতি যেন কোনোভাবেই আবার চালু হতে না পারে, এ জন্য সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলে। তাদের দাবি, সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠন সেখানে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করার চেষ্টা করছে। এখানে জানিয়ে রাখা ভালো, শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার পর ২০১৯ সালে এক ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারির মাধ্যমে বুয়েটে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। রাজনীতি চালু হলে মূলত এখানে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কেউ রাজনীতি করতে পারবে না। ছাত্রদের তারা আবার র্যাগিং করবে, ছাত্রলীগের মিছিল মিটিং-এ যেতে বাধ্য করবে। না যেতে চাইলে পিটাবে। প্রয়োজনে মেরেই ফেলবে।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চালু হওয়া মানে ছাত্রলীগের একদলীয় আধিপত্য চালু হওয়া। ছাত্রদের ক্লাস বাদ দিয়ে বাধ্যতামূলক জয় বাংলা শ্লোগান দেওয়া। বুয়েটের অরাজনৈতিক শিক্ষকরা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হওয়া। বুয়েটের ছাত্রীরা ছাত্রলীগ ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। রাজনীতি চালু থাকা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই হয়। বুয়েটেও তার ব্যাতিক্রম হবে না।
- লেখক : লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post