অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
জাতীয় কোনো দিবস আসলে আওয়ামীলিগের কথিত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে তৃনমূল নেতাকর্মীরা চেতনার নামে নিজেদের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে থাকেন। মহান বিজয় দিবসেও দেখা গেছে সে চিত্র। ১৬ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু করে সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, পতাকা অবমাননা থেকে শুরু করে বিভিন্ন নৈরাজ্য চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরা।
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এছাড়া পতাকা অবমাননাসহ শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাঙচুর ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে।
ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে ইবিতে দফায় দফায় সংঘর্ষ
বিজয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে গিয়ে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
১৬ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় ফুল দেয়ার জন্য বেদিতে ওঠে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বঙ্গবন্ধু পরিষদ কর্মকর্তা ইউনিট। এ সময় তারা জুতা পায়ে বেদিতে উঠেছেন বলে প্রতিবাদ করতে থাকেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। কর্মকর্তা সমিতির সদস্যরাও এর প্রতিবাদ করেন। এতে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা তাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। এ সময় উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং ফুলের ডালি নিয়ে টানাহেঁচড়ার একপর্যায়ে তা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
পরবর্তীতে টেকনিক্যাল সহায়ক কর্মচারী সমিতি ফুল নিয়ে বেদিতে উঠলে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় শ্রদ্ধাঞ্জলির জন্য নেয়া ফুল পদদলিত হয়। এরপর ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ও বেদিতে উভয়পক্ষের ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের ধাওয়া দিয়ে কর্মকর্তা সমিতির সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পার করে দেন। এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক কর্মকর্তা মো. সেলিম ও আজিজুর রহমান, অস্থায়ী কর্মচারী সুলাইমানসহ কয়েকজনের কাছে হেনস্তার শিকার হন। প্রতিবাদ করতে গেলে তারা সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন। পরে তারা মৌখিকভাবে ক্ষমাও চান।
পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যর্থ হয়। এছাড়া প্রক্টরিয়াল বডিকেও নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক শাহিনুর রহমান সবাইকে শান্ত হওয়ার আহবান জানালে তখনো হাতাহাতি চলতে থাকে। এক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে আসে।
বেরোবিতে বিকৃতি পতাকা বানিয়ে আওয়ামী শিক্ষকদের ফটো সেশন
বিজয় দিবসে নিজেদের মতো করে তৈরি করা জাতীয় পতাকা নিয়ে ক্যাম্পাসে তোলা ছবি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন দলের নিয়গপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর ডিজাইন পরিবর্তন করে ওই শিক্ষকরা সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তের পরিবর্তে চতুর্কোণা লাল আকৃতি দিয়ে তৈরি করা জাতীয় পতাকা ধরে ক্যাম্পাসে ছবি তোলেন। পরে ছবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নজরে পড়লে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ছবিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধান, বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. পরিমল চন্দ্র বর্মন, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শামীম হোসাইন, ইতিহাসের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক সোহাগ আলী, মার্কেটিং বিভাগের সহকারি অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মাসুদুল হাসান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রাম প্রসাদ, সহকারী অধ্যাপক কাইয়ুম এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বাসক রহমতউল্লাহ তাদের মতো করে বানানো পতাকা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাদের ছবিসহ নিজের ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুল হক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন- আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত, কারণ এরা সবাই ‘শিক্ষক’!
তার স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিজয় দিবসে জাতীয় পতাকাকে অবমাননা! পতাকার ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। বৃত্ত না দিয়ে, চারকোনার মতো আকৃতি দেয়া হয়েছে। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কী উদ্দেশ্য, কেন পতাকার ডিজাইন পরিবর্তন করা হলো, ১/১১-এর কুশীলব না স্বাধীনতা বিরোধী, কারা তারা, কে পেছনে তা জনগণ জানতে চায়। এটা কোন খেলনা নয় যে পরিবর্তন করা যায়। জাতীয় পতাকা আইন অনুযায়ী এটা অপরাধ। রাষ্ট্রবিরোধী কাণ্ড। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই প্রধান কর্মসূচি! আলোকসজ্জাও হয়নি ক্যাম্পাসে। ছবিতে যারা আছেন তাদের একজন ডিন, একজন প্রভোস্ট, একজন সহকারী প্রক্টর, দুজন সহকারী প্রভোস্ট। এরা সবাই দায়িত্বশীল, উপাচার্যের নিয়োগপ্রাপ্ত ও ঘনিষ্ঠজন! এরাই বিশ্ববিদ্যালয় চালায়।’
এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকদের বিজয় দিবসে কোন অনুষ্ঠানে ডাকে না, অংশগ্রহণ করতে দেয় না বলেও ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন মাহমুদুল হক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই শিক্ষকরা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এর মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত। যিনি আওয়ামীপন্থী একজন শিক্ষক। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে বেশ সমালচিতও হয়েছেন। নিয়োগ বানিজ্য থেকে শুরু করে নিয়মিত ক্যাম্পাসে না আসা, শিক্ষকদের ওপর জুলুম, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এছাড়া ২০১৯ সালে আশির দশকের বলিউডের জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘ডিসকো ড্যান্সার’-এর সুপারহিট গান-‘আই এম এ ডিসকো ড্যান্সার’ গানের তালে তালে শিক্ষার্থীদের সাথে নেচে বেশ সমালোচনায় এসেছিলেন এই ভিসি কলিমউল্লাহ।
স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়া নিয়ে নুরের সমর্থকদের পেটালো ছাত্রলীগ
মহান বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরের সমর্থকদের পিটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
জানা যায়, সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদের ব্যানারে ভিপি নুরের সমর্থকরা স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান।
এ সময় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী বলে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে বাধা দেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও তার কর্মী-সমর্থকরা।
পরে ফুল দিয়ে স্মৃতিসৌধ এলাকা ত্যাগ করার সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয়। এ সময় ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় স্মৃতিসৌধ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ নেতাকর্মীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধের সামনের সড়কে মিছিল করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জুয়েল মিয়া বলেন, আমরা ৩০-৪০ জন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাই। ছাত্রলীগ নেতারা আমাদের বাধা দিয়ে বলেন, ৪-৫ জনকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে। আমরা তাদের কথামত ৪-৫ জন নিয়ে ফুল দিয়ে স্মৃতিসৌধ ত্যাগ করি।।
পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে আমাদের জেলা কমিটির সভাপতি আশরাফুল হাসানসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের সঙ্গে কোনো শিবিরকর্মী ছিলেন না। মাদরাসা ১০/১৫ জন ছাত্র ছিলেন।
সরিষাবাড়ীতে আ’লীগের দু’গ্রপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
জামালপুরে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াকে ঘিরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে তিন পুলিশ সদস্যসহ ৩০ জন আহত হয়েছেন। এ সময় পাঁচটি মোটরসাইকেল ও পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
দলীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে যমুনা সার কারখানা এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বাড়িতে গতকাল রাত আটটা থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের হেলাল উদ্দিন সেখানে যাওয়ার পথে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদ মুরাদ হাসানের সমর্থক সাখাওয়াত আলম তাঁকে মারধর করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রফিকুল ও মুরাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রাত ১০টা পর্যন্ত কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে তিন পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের ৩০ জন আহত হন। খবর পেয়ে তারাকান্দি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ সময় পরিদর্শক (তদন্ত) তরিকুল ইসলাম তালুকদার, পুলিশ সদস্য আবদুস সালাম ও সাইফুল ইসলাম আহত হন।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনসহ (২৬) অন্তত ২২ জনকে প্রথমে সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে মামুনসহ ছয়জনকে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা আল মামুনকে রাতেই ঢাকার চক্ষু হাসপাতালে নেওয়া হয়।
হাজীগঞ্জে আ. লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় উভয় গ্রুপের অন্তত ২০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ১শ ২২ রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করেছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানা যায়, কুষ্টিয়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলালসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু বিকেলে সমাবেশ শুরুর আগে আওয়ামী লীগের অপর একটি গ্রুপ সেখানে হামলা করে সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর উভয় পক্ষ দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িতে পড়ে।
নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে। এ সময় হাজীগঞ্জ থানা-পুলিশের সঙ্গে জেলা থেকে আসা দুই প্লাটুন পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম উভয় পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করে।