ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর মন্তব্যের পর মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফরাসি পণ্য বয়কট শুরু হয়েছে। কুয়েত, জর্ডান এবং কাতারের কিছু কিছু দোকান থেকে ফরাসি পণ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া লিবিয়া, সিরিয়া এবং গাজা উপত্যকায় বিক্ষোভও দেখা গিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই বয়কট মুসলিম বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ছে।
শ্রেণীকক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন দেখানোর পর এক শিক্ষককে হত্যার ঘটনায় ম্যাক্রোর মন্তব্যের পর এই প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, স্যামুয়েল পাটি নামের ওই “শিক্ষক খুন হয়েছিলেন কারণ ইসলামপন্থীরা আমাদের ভবিষ্যৎ চায়”, কিন্তু ফ্রান্স “আমাদের কার্টুন ছাড়বে না”।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিত্রাঙ্কন মুসলিমদের জন্য গুরুতর আপত্তির জায়গা হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী মুহাম্মদ (সা.) এবং আল্লাহর প্রতিকৃতি তৈরি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
কিন্তু ফ্রান্সে জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম অংশ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা বা “লেইসিতে”। কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অনুভূতির রক্ষার জন্য বাক-স্বাধীনতা কমিয়ে আনা হলে তা জাতীয় ঐক্য কমিয়ে আনবে বলে জানানো হয়।
রোববার, ম্যাক্রো এক টুইটে ফরাসি মূল্যবোধের প্রতি পক্ষে তিনি বলেন, “আমরা কখনোই এটা বিসর্জন দেবো না।”
তুরস্ক এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ম্যাক্রোর প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে অভিযোগ তুলেছেন যে তিনি “বিশ্বাসের স্বাধীনতা” কে কদর করছেন না এবং ফ্রান্সের লাখ লাখ মুসলিমদের কোণঠাসা করছেন।
রোববার, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, ইসলামের প্রতি ম্যাক্রোর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে তার “মানসিক চিকিৎসা করানো দরকার।” শনিবার একই মন্তব্যের জন্য তুরস্কে থাকা ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল দেশটি।
বয়কট কতদূর গড়িয়েছে?
রবিবার জর্ডান, কাতার ও কুয়েতের অনেক দোকানের তাক থেকে সরিয়ে নেয়া হয় ফরাসি পণ্য। ফ্রান্সে তৈরি হওয়া চুল এবং সৌন্দর্য পণ্য ডিসপ্লে-তে রাখা হয়নি। কুয়েতে প্রধান একটি রিটেইল ইউনিয়ন ফরাসি পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।
বেসরকারি ইউনিয়ন অব কনজ্যুমার কো-অপারেটিভ সোসাইটি বলে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে “বার বার অসম্মান” করার কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করে লিখেছে, “বয়কটের এই ডাক ভিত্তিহীন এবং অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। সেই সাথে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে উগ্র সংখ্যালঘুদের পরিচালিত সব হামলাও বন্ধ করা উচিত।” বিভিন্ন আরব দেশ যেমন সৌদি আরবে অনলাইনে এ ধরণের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ সৌদি আরবে ফরাসি সুপারমার্কেট চেইন শপ “ক্যাফৌউ” বয়কট করা নিয়ে হ্যাশট্যাগ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ট্রেন্ডিং ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে। এদিকে, লিবিয়া, গাজা এবং উত্তর সিরিয়ার তুরস্ক সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ফরাসি বিরোধী ছোট ছোট বিক্ষোভও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ফ্রান্স কিভাবে এই বিতর্কে জড়ালো?
পাটির হত্যার পর ইসলামের নামে উগ্রতার বিপক্ষে এবং ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ম্যাক্রোর অবস্থান মুসলিম বিশ্বের অনেকেরই ক্ষোভের কারণ হয়েছে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এক বক্তব্যে বলেন, “ইসলাম এবং মুসলিমদের নিয়ে ম্যাক্রোর মতো ব্যক্তিদের কী সমস্যা?”
এর মধ্যে পাকিস্তানের নেতা ইমরান খান ফরাসি নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে তিনি “কোন কিছু না বুঝেই তিনি ইসলামকে আক্রমণ করছেন”।
এক টুইটে তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো ইউরোপ এবং পুরো বিশ্বে থাকা মুসলিমদের অনুভূতিকে আঘাত করেছেন।”
চলতি মাসের শুরুর দিকে, ওই শিক্ষকের হত্যার আগেই ম্যাক্রো ফ্রান্সে “মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের” রুখতে কঠোর আইন তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
তিনি ইসলামকে “সংকটে” থাকা ধর্ম উল্লেখ করে বলেন, ফ্রান্সের প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম “কাউন্টার সোসাইটি” তৈরির চিন্তা করছে। ফ্রান্সে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিকৃতি আঁকার অন্ধকার রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে। ২০১৫ সালে তার কার্টুন প্রকাশের পর ফরাসি ব্যঙ্গ-পত্রিকা শার্লি এবদোর ১২ জন এক হামলার মারা গিয়েছিল।
পশ্চিম ইউরোপের মুসলিম সম্প্রদায় ম্যাক্রোর বিরুদ্ধে তাদের ধর্মকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টা এবং তার এই প্রচারণা ইসলামোফোবিয়াকে বৈধতা দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করবে বলে অভিযোগ করেন।
সূত্র : বিবিসি