– হাসান রূহী
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ছোট বড় ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। গত দেড় দশকে তা বেড়েছে আরও। বিশেষ করে ২০০৭ সালের ভয়াবহ সিডর এবং এরপর ধারাবাহিকভাবে আইলা, মহাসেন, নার্গিস, ফনী, বুলবুলের প্রভাবে বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের উপকূলবাসী। শুধু উপকূল কেন? হাওড়ের মানুষের দুঃখ দুর্দশার সিংহভাগই জড়িয়ে আছে এই বাঁধ। প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সামনে সিঙ্গাপুর হতে চলা ইমার্জিং টাইগার বাংলাদেশ যখন ঝড়-বৃষ্টি, জলোচ্ছাসে নিয়মিত নাকানি চুবানি খায় তখন আসলেই বড্ড বেমানান দেখায়।
করোনার প্রকোপ চলমান অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার পর থেকে দেশের অবস্থা আরও বেশ নাজুক হয়ে পড়েছে। অবশ্য প্রচন্ড ঝড়ের আঘাতে উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ ভেসে গিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করলেও ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রী হেলিকপ্টার নিয়ে ঘুরেও নাকি কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘর দেখতে পাননি। তবে এ বানের জলে যে দক্ষিণের মানুষের ঈদের আনন্দ ভেসে গেছে তা স্পষ্ট হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিছু ছবি দেখে।
খুলনার কয়রা এলাকার ভাগ্যাহত মানুষগুলো ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সরকারি কোনো উদ্যোগের কিনারা করতে না পেরে ঈদুল ফিতরের দিনেও সকাল থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ নির্মাণ করছিল। এর মধ্যেই যখন জোয়ারের পানি চলে আসে তখন তাদের আর কিছুই করার থাকে না। স্থানীয় জনৈক জামায়াত নেতার ইমামতিতে তারা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়েই আদায় করেছেন ঈদের নামাজ। এসব নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কথা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। তাতে লাভও হয়েছে। কয়রার মানুষ এখন পর্যন্ত কি পেয়েছে তা জানতে পারিনি। তবে খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩১ নম্বর পোল্ডারের ৪৭ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ১২শ’ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলে পত্রিকার খবর মারফত জানতে পেরেছি।
হয়তো দাকোপের মত অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য আরও অনেক প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও একনেক সভায় অনুমোদন হবে। আগেও এমন বরাদ্দ বহুবার হয়েছে। গ্রহন করা হয়েছে অনেক প্রকল্প। কিন্তু তাতে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি প্রকৃতির কাছে অসহায় মানুষগুলোর। জলবায়ু তহবিল থেকে তাদের প্রাপ্য টাকা ব্যয় করে হাছান মাহমুদের মত আওয়ামী নেতারা শখের পার্ক তৈরী করার মত ঘৃণ্য নজিরও স্থাপন করেছেন।
জলবায়ু ট্রাস্টি বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি এবং পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তাঁর নিজের জেলা শুধু চট্টগ্রামের জন্যই সর্বোচ্চ ১২টি সরকারি প্রকল্প বরাদ্দ দিয়েছিলেন। টাকার পরিমাণ ৯৮ কোটি। অথচ সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা খুলনা বিভাগের জন্য ২৪ কোটি টাকার মাত্র একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। আর এই নয়-ছয়ের লুটপাট জায়েজ তরীকায় করার জন্য সেসময়ে হাছান মাহমুদ ১১টি ভূয়া এনজিও তৈরী করেছিলেন। যেসব এনজিওর অধিকাংশেরই এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। এছাড়াও ‘জলবায়ু তহবিলের টাকা অপাত্রে’ কতটা ঢালা হয়েছিল তার বিবরণ আমরা পত্রিকায় অনেকেই পড়েছি।
আজকে কলম ধরেছি শুধু এই কারণেই। একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই। আমাদের দেশে একটা প্রচলিত কথা আছে। আর তা হলো- ‘স্রোতের মুখে চাক (মাটির চাক) দিয়ে বাঁধ দেয়া যায় না’। কথাটা কতটা সত্য তা বুদ্ধিমান মাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন। দুর্যোগে ভূক্তোভুগী মানুষদের রক্ষা করার জন্য সরকারের তরফ থেকে অনেক পদক্ষেপই হয়তো নেয়া হবে। তবে সেসব পদক্ষেপ জনগণের কতটা কাজে লাগবে তা হিসেব করে দেখার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের উপকূলে বাঁধ কম বাঁধা হয়নি। কিন্তু সেসব বাঁধ দুর্যোগের সময় ভেসে যাওয়াই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। বাঁধ যদি ভেসেই যায় সে বাঁধের দরকারটা কি!
করোনা সংক্রমণ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন- ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী।’ শুধু কথায় নয় কাজেও এর প্রমাণ দিয়েছে দখলদার ক্ষমতাসীনরা। পাকিস্তান আর ভারতের জনগণ যখন লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল নিয়ে পঙ্গপালের আক্রমণের ভয়ে চুপসে আছে। ঠিক সেই সময়ে এদেশের বঙ্গপালরা হাজার হাজার টন চাউল খেয়ে দিনে দুপুরে সাবাড় করে দিয়েছে। ফলে করোনার আঘাতে নিহত মানুষের তুলনায় ক্ষুধায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি ছাড়া কম হওয়ার কথা না। পত্রিকার পাতায় খাবারের অভাবে আত্মহত্যার খবর বোধকরি আপনারাও পড়ে থাকবেন। মোটকথা বঙ্গপালেরা পঙ্গপালের চেয়ে শক্তিশালী এটা এখন দেশে প্রমাণিত সত্য। এটা মানুষ এখন চোখ বুজে স্বীকার করে।
সুতরাং, বঙ্গপালেরা যে শুধুই চাল, গম, তেল খাবে তা কিন্তু নয়। কারণ এরা তো আর পঙ্গপাল নয় যে খাদ্য শস্য ধ্বংস করেই ক্ষান্ত থাকবে! এরা খাওয়া শুরু করলে বাঁধ নির্মানের মাটি থেকে শুরু করে বালু, সিমেন্ট, ব্লক, রড, পাথর পর্যন্ত খেয়ে ফেলবে। হাজার হাজর টন কয়লা খেয়ে যারা বাতাসে উড়ে গেছে বলে চালিয়ে দিতে পারে, তাদের পক্ষে অসম্ভব বলে আসলে কিছুই নেই। তাহলে দক্ষিণাঞ্চলের ভাগ্যাহত মানুষগুলোর কি হবে? বৈশ্বিক জলবায়ু যেভাবে দিন দিন ফুঁসে উঠছে তাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে আমরা সবাই আসলে চিন্তিত, শঙ্কিত। তাই এর আশু সমাধান প্রয়োজন। এমতাবস্থায় দুর্নীতির ভয়াল স্রোতের মুখে বেড়িবাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের চাক দিলে আসলে খুব বেশি লাভ হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে শক্ত হাতে দুর্নীতি দমনের কোনো বিকল্প নেই।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডবের এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি উপকূলের বাসিন্দাদের। ভাঙা বাঁধ থেকে প্রতিনিয়ত জোয়ারের পানি ঢুকে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। জোয়ার হলেই ভাঙা বাঁধ থেকে প্রতিদিন হু হু করে পানি প্রবেশ করে। তলিয়ে যাচ্ছে বসত-ভিটা ফসলের ক্ষেত, পশু ও পাখির খামার। পানিবন্দি লক্ষাধিক মানুষ। ঘরহারা অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। জেলা প্রশাসন নামমাত্র ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও মানুষের বাস্তব প্রয়োজন যে তারচেয়ে কতটা বেশি তা এমন বিপদে যারা পড়েছেন শুধুমাত্র তারাই ভালো বুঝবেন। তাই আশ্রয় ও সম্বলহীন এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিলম্ব যেমন কাম্য নয়, তেমনি প্রকল্প বরাদ্দের নামে দলীয় গুন্ডাদের মাঝে লুটপাটের ভাগ-বাটোয়ারাও কেউ প্রত্যাশা করে না। সরকারকে জনগণের এই চাহিদা বুঝতে হবে। এটা যত দ্রুত তারা বুঝতে পারবে ততই কল্যাণ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট