ফিরোজ মাহবুব কামাল
কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ১২ই মার্চ এমন এক বিষয়ে সম্পাদকীয় ছেপেছে যা পত্রিকায় না পড়লে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো। বিষয়টি বেছে বেছে মুসলিমদের শাস্তি দেয়ার আইন।আধুনিক যুগে এমন আইন কোন দেশে থাকতে পারে -সেটি কল্পনা্ করাই কঠিন। ভারতের বুকে কীরূপ অসভ্য ও নৃশংস শাসন চেপে বসেছে -এ হলো তারই এক করুণ চিত্র। ভয়ানক দুশ্চিন্তার কারণ হলো, ভারতের ২০ কোটি অসহায় মুসলিম এ অসভ্য ও নৃশংস শাসক ও তাদের দলীয় গুন্ডাদের হাতে জিম্মি। তারা যে কোন সভ্য দেশে সরকারের কাজ হয়, অন্যায়ের নির্মূল এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ভারতে হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অসভ্যতার অতি নৃশংস চিত্রটি ২০০২ সালে দেখা গিয়েছিল গুজরাটে। তখন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিল আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি মুসলিম গণহত্যার সে গুজরাটি মডেলকেই সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা দিল রাজধানী দিল্লিতে।
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা বিজিপি সরকারের সে অসভ্য চিত্রটি তুলে ধরেছে “বিষম ব্যবস্থা” শিরোনামায়। সেটি সরকারের একটি আইন নিয়ে। সে আইনি বিধানটি হলো, যদি কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, ও শিখ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে বেড়াতে এসে ভিসায় প্রদত্ত মেয়াদের চেয়ে অধিক কাল অপেক্ষা করে তবে তাকে ১০০ রুপি জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু সেটি যদি কোন মুসলিমের পক্ষ থেকে হয় তবে তাকে ২১ হাজার রুপি জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ মুসলিম ব্যক্তির জরিমানাটি হবে ২০০ গুণ। ধর্মের নামে এ এক বিস্ময়কর বৈষম্য!
এটি কি কোন সভ্য দেশের আচরণ? পাকিস্তান ভারতের ন্যায় নিজেকে ধর্ম নিরেপক্ষ রাষ্ট্র বলে দাবি করে না। শাসনতান্ত্রিক ভাবে দেশটি শুরু থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সেখানেও নানা দেশের নানা ধর্মের মানুষ বেড়াতে আসে। ভিসায় প্রদত্ত মেয়াদের চেয়ে বেশি কাল অপেক্ষা করে –এমন ঘটনা সেখানেও বিরল নয়। কিন্তু দেশটি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করে –এমন অভিযোগ এমন কি দেশটির শত্রুগণও এ অবধি অভিযোগ তোলেনি। আইন ভঙ্গ হলে সে দেশে সবাইকে একই জরিমানা দিতে হয়। অপর দিকে ভারতীয়রা গর্ব করে ধর্মনিরেপেক্ষতার দাবি নিয়ে। প্রশ্ন হলো, আইন প্রয়োগে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এরূপ পক্ষপাত-দুষ্টতা কি ধর্মনিরপেক্ষতা? ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভারতে কীরূপ অসভ্য জালিয়াতি চলছে –আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় হলো তারই নজির।
যারা আইন প্রণয়ন করে তারা গাঁজাসেবী বা মাতাল নয়। তারা উচ্চ শিক্ষিত। তাদের মনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পর্বত-সমান ঘৃণা না থাকলে কি এমন আইন তৈরী করতে পারে? সে ঘৃণাটি যেমন দাঙ্গার নামে গণহত্যাতে প্রকাশ পায়, তেমনি প্রকাশ পায় আইনের প্রয়োগে। ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণা যে শুধু সে দেশের আইন-প্রণেতা বিজিপি সাংসদদের মাঝেই বিরাজ করছে -তা নয়। সে বিষাক্ত ঘৃণাটি দেখা যায় ভারতীয় পুলিশ ও ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারকদের মাঝেও। দেখা যায় হিন্দু মিডিয়া কর্মীদের মাঝেও। তাই কোথাও মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটপাট শুরু হলে পুলিশকে সে অপরাধ দমনে দ্রুত ময়দানে নামতে দেখা যায় না। ময়দানে নামলেও তারা অপরাধ থামায় না। বরং দেখা যায় হিন্দু গুন্ডাদের সাথে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পাথর ছুড়তে বা লাঠি দিয়ে পিঠাতে। সেটি প্রামাণ্য চিত্র দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়া পড়া ভিডিওগুলোতে। এমন গভীর ঘৃণা নিয়েই দিল্লির পুলিশগণ মুসলিম গণহত্যা এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর্বটি তিন দিন ধরে চলতে দিয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে পুলিশ কিছু সংখ্যক মুসলিম যুবককে রাস্তায় ফেলে পিটাচ্ছে এবং তাদেরকে বলছে জয় শ্রীরাম বলতে। এদের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটেছে। এমন পুলিশকেই বাহবা দিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। উল্লেখ্য হলো এই অমিত শাহের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ উঠেছিল ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম বিরোধী গণহত্যায় জড়িত থাকা নিয়ে। দিল্লির পুলিশ যেহেতু অমিত শাহের অধীন, মুসলিম গণহত্যার সে গুজরাতী মডেলেরই প্রয়োগ হলো এবাব দিল্লিতে। সেটিই লিখেছে কলকাতার “দি টেলিগ্রাফ” পত্রিকাটি।
পুলিশ ও বিজিপির গুন্ডাদের ন্যায় ভারতের উচ্চ-আদালতের বিচারকদের মুসলিম বিদ্বেষ কি কম? হিন্দু গুন্ডারা কোন মসজিদ ভাঙ্গলে ভারতের উচ্চ-আদালতের বিচারকদের কাছে সেটি কোন অপরাধ গণ্য হয় না। সে গুন্ডামীর জন্য কারো কোন শাস্তি হয় না। বরং আদালতের কাজ হয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের জমিতে মন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেয়া। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এমন রায়ই দিয়েছে্ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘৃণ্য অপরাধকে জায়েজ করতে। বিজিপি’র নেতাগণ যখন প্রকাশ্যে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে “গোলি মারো শালেকো” বলে গুন্ডাদের উস্কানী দেয় -সেটিও বিচারকদের কাছে অপরাধ রূপে গণ্য হয় না। দিল্লিত ৯ মসজিদের উপর হামলা হয়েছে, মসিজদের মিনারে হনুমান অংকিত গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে অপবিত্র করা হয়েছে -কিন্তু সে অপরাধে পুলিশ কাউকে ধরেনি। বরং নিরব দাঁড়িয়ে দেখেছে। তাই আদালত থেকে কারো কোন শাস্তিও হয়নি। আইনের প্রয়োগ ও জানমালের নিরপত্তা দিতে ভারত যে কতটা ব্যর্থ রাষ্ট্র -এ হলো তারই প্রমাণ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা যে কতটা সঠিক ছিল এবং ৪০ কোটি মুসলিমের জীবনে দেশটি যে কীরূপ বিশাল কল্যাণ দিয়েছে -সেটি বুঝার জন্য ভারতীয় হিন্দুদের এরূপ অসভ্য শাসনই যথেষ্ট। একমাত্র ভারতের সেবাদাসগণই পাকিস্তান সৃষ্টির অপরিসীম কল্যাণকে অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশী জনগণের বিপদ হলো, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের প্রতি নতজানু দাসত্ব নিয়ে বাঁচতে চায় এমন অসভ্য মুসলিম বিদ্বেষীদের সংখ্যাটি ভারতের ন্যায় বাংলাদেশেও বিশাল। বরং সত্য তো এটাই, বাংলাদেশে শাসন চলছে এরূপ নৃশংস ফ্যাসিস্টদেরই। এবং সে শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং বেঁচে আছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য নিয়েই। চাকর-বাকর ও দাসী-বাঁদীর মাঝে দুর্বৃত্ত মনিবের খুন-খারাবী ও ধর্ষণের ন্যায় অপরাধের নিন্দার সাহস থাকে না। তারা বরং সে অপরাধে জোগালের কাজ করে। সে ভূমিকাটিই পালন করছে ভারতপালিত শেখ হাসিনা। তাই ভারতে মুসলিম হত্যার নিন্দা না করে শেখ হাসিনা সে দেশের অসভ্য ও দুর্বৃত্ত নরেন্দ্র মোদির প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসার করেছে।