ফারুক ওয়াসিফ
সময়ের কী সুন্দর সব নাম। সম্রাট থেকে পাপিয়া। ঢাকাই সিনেমার কী সুন্দর প্লট। গতকাল যিনি সম্রাট, আজ তিনি কারাগারে। গতকাল যিনি আদরণীয়–বরণীয় নেত্রী, আজ তিনি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। যেসব গল্প বিনোদন পাতায় ছাপা হতো, সিনেমায় দেখা যেত, সেসব এখন তাজা বাস্তব খবর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা কাহিনির চেয়ে রঙিন। কয়েক দিন এসব নিয়ে মেতে থাকবে সংবাদমাধ্যম, মেতে থাকবে ফেসবুক, জমে উঠবে চায়ের আড্ডা। ঢাকা পড়ে থাকবে আরও কঠিন করুণ বাস্তবতা। মানুষের মনোভাব যা বুঝছি তা এই, খেপে লাভ নেই, তার চেয়ে দেখে নিই।
সব দেখে–শুনে কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ পাপিয়ারা আগেও ছিলেন, পরেও আশা করি থাকবেন। যাঁদের জানার তাঁরা জানতেন। জানতেন বলেই পাপিয়ারা কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটেন, কর্মী থেকে বড় নেত্রী হয়ে ওঠেন। ওপরে ওঠার এই সিঁড়িতে তাঁর সঙ্গে ওপর মহলের অনেকেরই দেখা হয়েছে। রাষ্ট্রের শীর্ষ থেকে বড়-মেজ অনেকের সঙ্গেই তাঁর ঝলমলে ছবি আছে। পাপিয়াই এসব তাঁর ফেসবুক ওয়ালে দিয়ে কতজনের মনে হিংসার আগুন জ্বালিয়েছেন। তাঁর এই সাফল্যে নিশ্চয়ই তাঁর কাছের মানুষেরা একসময় গর্বিত হয়েছে। বড় বড় মানুষের আশপাশে-কাছে-নিবিড়ে যাঁর এমন ছবি থাকে, তাঁর হাত কতটা লম্বা ছিল, তা অনুমান করা যায়। সেই হাতগুলো কি তাঁকে বাঁচাবে না?
২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নরসিংদীর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল সমকালকে বলেন, পাপিয়াকে যুবলীগ নেত্রী বানানোর সময় স্থানীয় নেতা–কর্মীরা বিরোধিতা করেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা তা আমলে নেননি। কাউন্সিল শেষে এলাকায় নয়, পাপিয়ার নাম ঘোষিত হয় ঢাকা থেকে। অতএব পাপিয়া হঠাৎ আসা নেত্রী নন, ওপরের হাত অনেক দিন ধরেই তাঁকে ধাপের পর ধাপে টেনে তুলেছে। হঠাৎ কী এমন ভুল করে ফেললেন যে তাঁকে রসাতলে পড়তে হলো?
যে পাপিয়া আনন্দের, সাফল্যের ছবি হয়ে ভাসতেন, তিনিই কিনা অপরাধের খবরের ছবি হয়ে এলেন। এখন কেউ তাঁকে চিনবেন না। তা তো হতেই পারে। কতজনই তো কতজনের সঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ নিয়ে আসেন। সব কি আর ‘না’ করা যায়? ভদ্রতা-সভ্যতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। তারপর যেই গোমর ফাঁস হলো, অমনি সবার বোধোদয় হবে। ক্ষমতার তারকারাজির মধ্যে ঝলমল করতে থাকা এই নারীকে এখন কেউই চিনবেন না। বলবেন, আমরা এসব জানতাম না। কেউ কেউ বলবেন, তাঁরা ভুল বুঝেছিলেন। আমরাও বিশ্বাস করব সব দোষ পাপিয়ার। এই অবস্থায় আমরা অনুমান করতে পারি পাপিয়ার মনের কথা: ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’।
এই রকম দিনে ঘুম ভেঙে উঠে জাতি যখন পাপিয়া পাপিয়া করছে, তখন মনে পড়ছে ক্যাসিনো–কাণ্ডে কুখ্যাতি কুড়ানো যুবলীগের সাবেক নেতা সম্রাটের কথা। মনে পড়ছে সম্রাটের পৃষ্ঠপোষক যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর কথা। বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, সম্রাটেরা যখন এত কিছু করছিল ‘তখন কি আপনারা আঙুল চুষছিলেন?’ আফসোস আজ, তিনি সে রকম কথা বলার জায়গায় নেই। তবে ইতিহাস শূন্যতা পছন্দ করে না। ওমর ফারুক সাহেব না থাকলেও যুব মহিলা লীগের আরেক নেত্রী তুহিন আছেন। তাঁর সঙ্গে পাপিয়ার ঘনিষ্ঠতার কথাবার্তা সংবাদমাধ্যমে আসায় তিনি মুখ খুলেছেন। ভালো কথাই তিনি বলেছেন, ‘তাদের পেছনে কে কে আছে, তাও বের করা হোক।’
তাদের পেছনে কে কে আছে, তা বের হোক, তা সবাই চায়। কতটা হবে, তা সময়ই বলবে। পাকেচক্রে সবাই যেখানে একাকার, সেখানে এক অঙ্গ আরেক অঙ্গকে পাকড়াও করবে, অতি বড় আশাবাদীও সেটা ভাববেন না। কিন্তু ভাবছি সেসব মেয়ের কথা, চাকরি দেওয়ার নাম করে পাপিয়া যাঁদের তাঁর ক্ষমতাশালী খদ্দেরদের কাছে সরবরাহ করেছিলেন। সেই খদ্দেরদের নামধাম জানবে বা জানাবে, সেই সাধ্য এমনকি সাংবাদিকদেরও নেই। থাকলেও বলার পথ নেই। কিন্তু চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট একেকটি ঘটনা। নারী, মাদক, অস্ত্র, রাজনৈতিক ক্ষমতা মিলিয়ে একটা চক্র। প্রতিটি বড় অপরাধের তলায় হাত দিলেই দেখা যায়, কী সব ভয়ংকর খেলা সেখানে চলছে। কোনো একটি ঘটনার এই জগৎকে আড়াল করা পর্দাটা বাতাসে দুলে উঠলে ভেতরের ছায়াছবিটা সামান্য দেখা যায়। এই গল্পে নারীদের যেমন অপরাধী হিসেবে পাওয়া যায়, একই সঙ্গে তাঁদের দেখি ভিকটিম হিসেবেও। পাপিয়া একটা রাজনৈতিক অর্থনীতির ফল। অন্যায়, দুর্নীতি, অনাচারের যে বিষবৃক্ষ রাজনীতির মাটি থেকে মাথা তুলে পুরো সমাজটাকেই ছেয়ে ফেলেছে, পাপিয়ারা তার ডালপালা মাত্র। বেদিকে বেশি বেড়ে গেলে অথবা ভুল জায়গায় খোঁচা দিয়ে ফেললে তাদের ঝেড়ে ফেলা হয়। এদের নিকাশের মাধ্যমে পাপচক্র দুর্বল হয় না, বরং আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়। মাদকবিরোধী অভিযান, শুদ্ধি অভিযান ইত্যাদি দেখে তাই আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
ব্যাপারটা খুব মজার। ক্যাসিনো-কাণ্ডের আগে যেমন কেউ জানত না যুবলীগের কিছু নেতা–নেত্রীর চরিত্র। তারপর একদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচমকা অভিযান, অনেক হইচই অনেক আলোচনা। আবার সব চুপ। তারপর আবার কোথাও ধর্মের কল রহস্যজনক কারণে নড়ে ওঠে, মনে হয় এবার বুঝি দুর্নীতির ঝাড়বংশ সব ওপড়ানো হবে। সরল–সিধা মানুষেরা অনেক আশাবাদী হয়ে ওঠে। ইয়াবাবিরোধী দেশময় অভিযানের সময় এই আশা করা হয়েছে। কয়েকজন ধর্ষককে বিনা বিচারে হত্যার পরেও এমন আশা জেগেছে। পাপিয়ার গ্রেপ্তারের পরও কেউ কেউ বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান বন্ধ হয়নি। চলছে চলবে।
কিন্তু সম্রাট যেমন একা অপকর্ম করেননি, পাপিয়াও একা ছিলেন না। নারী ব্যবসা, প্রভাবশালীদের বিনোদনের খোরাক জোগানো, তাঁদের দিয়ে অবৈধ কাজ করিয়ে নেওয়া আবার তাঁদের গোপন সময়ের দৃশ্য ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করার মেলা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। কোটি কোটি টাকা, গাড়ির ব্যবসা, ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ির খবর আসছে। এত কিছু পাপিয়া করে ফেললেন সবার অজান্তে? যাঁর বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ টাকা, তিনি কী করে এত কিছু করলেন যদি না এই অবৈধ কাজকর্মে ক্ষমতার পাহারা না থাকত? পাপিয়া বা সম্রাটেরা হিমবাহের ভাসমান চূড়ামাত্র। তলায় রয়েছে আরও বড় ও গভীর এক জগৎ। এটাই বাংলাদেশের দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দরমহল।
সম্রাট বা পাপিয়ারা এই অন্দরমহলের টুকিটাকির নায়েব-গোমস্তামাত্র। বোকার মতো তাই প্রশ্ন করে লাভ নেই যে ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
লেখক: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক