গত কিছুদিন ধরে আসামের নাগরিকত্ব পঞ্জীর তালিকা ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে না। ভারতের আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি-র তথ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে গেছে।
গতবছরের ৩১শে অগাস্ট এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর থেকেই তাদের ওয়েবসাইটে ওই তালিকা দেখা যেত। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে সেই তালিকা আর দেখা যাচ্ছে না। খবর বিবিসি বাংলার।
এ নিয়ে আসামের একটা বড় অংশের মানুষদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। বিশেষ করে যে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ গেছে, তাদের মধ্যে।
এন আর সি নিয়ে তৃণমূল স্তরে কাজ করেন এমন একজন সমাজকর্মী শাহজাহান আলি বলেন, হঠাৎ করেই এন আর সি-র তালিকা আর ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে না। এটা কেন হল, সেটাও স্পষ্ট নয় বেশিরভাগ মানুষের কাছেই।
এনআরসি-র রাজ্য সমন্বয়ক হিতেশ দেব শর্মা অবশ্য বলছেন যে এটি একটি কারিগরী সমস্যা।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই তাকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে, ক্লাউড স্টোরেজে এই বিপুল পরিমান তথ্য রাখা ছিল উইপ্রো সংস্থার সঙ্গে একটি চুক্তির ভিত্তিতে। সেই চুক্তি গতবছর অক্টোবর মাসে শেষ হয়েছে। এর আগে যিনি সমন্বয়ক ছিলেন, তিনি ওই চুক্তি পুনর্নবায়ন করেন নি। তাই ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ক্লাউড স্টোরেজ পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ওই সংস্থাটি। আর আমি দায়িত্ব নিয়েছি ২৪শে ডিসেম্বর।
তিনি আরও বলেছেন যে উইপ্রোর সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে এই সমস্যা নিয়ে এবং তাদের আশা কয়েকদিনের মধ্যেই আবারও এনআরসি-র পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেখা যাবে ওয়েবসাইটে।
মুসলমানদের জন্য নতুন সমীক্ষা:
এদিকে এনআরসি নিয়ে এই বিতর্কের মধ্যেই আসামে আবারও একটি জনসমীক্ষা শুরু হতে চলেছে। এবার শুধু ভূমিপুত্র মুসলমানদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হবে এই সমীক্ষার মাধ্যমে। এবং তা হবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলমানদের মধ্যে বরাক উপত্যকাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।
আসামের মুসলমানদের মোটামুটি দুটো বড় গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয় – খিলঞ্জিয়া বা ভূমিপুত্র এবং ভাটি বা বঙ্গমূলের মুসলমান। অসমীয়া খিলঞ্জিয়া মুসলমানদের বসবাস কবে থেকে শুরু, তা নিয়ে দ্বিমত আছে।
কেউ মনে করেন মোগল-অহম যুদ্ধের পরে যে পরাজিত মুসলমান সৈন্যরা আসামে থেকে যান, তারাই আসামের প্রথম মুসলমান বাসিন্দা, কেউ আবার মনে করেন আসামে প্রথম মুসলমান বসতি আটশো বছর আগে থেকেই শুরু হয়।
অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নানা অঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে মুসলমান কৃষকদের নিয়ে এসে জমি দিয়ে চাষে উৎসাহ দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছিল।
খিলঞ্জিয়া বা ভূমিপুত্র মুসলমানদের সম্বন্ধে নতুন করে তথ্য কেন সংগ্রহ করতে হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে আসামের সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মুমিনুল আওয়াল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার আসামের সংখ্যালঘু উন্নয়নে যা অর্থ বরাদ্দ করে, প্রায় সবটাই চলে যাচ্ছে বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে। কারণ তারা একই এলাকায় সংঘবদ্ধ ভাবে থাকে।
অন্যদিকে খিলঞ্জিয়া মুসলমানরা যেসব এলাকায় থাকেন, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নয় বলে এই বরাদ্দ তাদের কাছে যায় না। সেজন্যই সমীক্ষা করা হচ্ছে।
এই সমীক্ষা নিয়ে সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর মঙ্গলবার একটি বৈঠক করেছে খিলঞ্জিয়া মুসলমানদের ২১ টি সংগঠনের সঙ্গে।
সেখানে গোরিয়া, মোরিয়া, দেশি, জলুহা এবং সৈয়দ – এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
বৈঠকে অবশ্য ডাকা হয় নি বরাক উপত্যকার বাংলাভাষী মুসলমানদের। যদিও তাদের প্রায় সকলেই ভূমিপুত্র, তবুও তাদের ওই সমীক্ষা থেকে বাদ রাখা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে আওয়াল বলছিলেন, বরাকের মুসলমানদের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলমানদের মূলগত ফারাক আছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ধরন – সবই আলাদা। তাই সরকার ওদের ব্যাপারে আলাদাভাবে চিন্তাভাবনা করবে।
এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বরাকের বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে। বরাকের মুসলমানদের সংগঠনগুলি এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে চিঠিও দিয়েছে সরকারের কাছে।
অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষী মুসলমানদের আশঙ্কা তাদের হয়তো এরপর সরকারী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে।
সমাজকর্মী শাহজাহান আলির কথায়, আসাম চুক্তির ৬নম্বর ধারায় ভূমিপুত্রদের জন্য সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা চালু হতে চলেছে তার আগেই এরকম একটা সমীক্ষার খবরে আমরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মুসলমানরা ভয়ে আছি। যারা বঙ্গমূলের মুসলমান, বাংলায় কথা বলি, তাদের খুঁজে বার করে এবার হয়তো সরকারি বরাদ্দ বা সুযোগ সুবিধা থেকে আমাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা হবে।
গুয়াহাটি হাইকোর্টের সিনিয়ার আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী প্রশ্ন তুলছেন এধরণের সমীক্ষার আইনগত দিক নিয়েও।
মুসলমানদের মধ্যে শিয়া আর সুন্নি ভাগ রয়েছে – কিন্তু এর বাইরে আবার কিসের ভাগাভাগি! কে আসামের ভূমিপুত্র সেই সংজ্ঞাই তো এখনও তৈরি হয়নি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে ভূমিপুত্র মুসলমান খুঁজে বার করা হবে? আমার তো মনে হয় না এধরণের সমীক্ষা আইনী ছাড়পত্র পাবে।
এই সমীক্ষা যাতে আইনী ছাড়পত্র পায়, তার জন্য অনুমতি নিতে হবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর থেকে – যারা আসামের এন আর সি পরিচালনারও মূল দায়িত্বে ছিল।
সূত্র: বিবিসি