অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আসামে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি) ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু এবং মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করে তোলার একটি হাতিয়ার। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেছে বেছে মুসলমানদের টার্গেট করা হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রহীন করতে এই এনআরসি তালিকাকে হাতিয়ার করছে ভারত সরকার। এরপর থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করেছে ভারতীয়রা।
সম্প্রতি ভারতের এনআরসি আতঙ্কে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে ভারতীয় বাঙালিরা। মহেশপুর সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য ভারতের সীমানায় অপেক্ষা করছে শত শত নারী-পুরুষ। এদিকে গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৫৯ জন অনুপ্রবেশকারীকে আটক করেছে বিজিবি।
বিজিবি ও থানা সূত্র জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে মহেশপুর উপজেলার জলুলী, পলিয়ানপুর, খোসালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অনুপ্রবেশের সময় ৫১ জন শিশু, ৪৭ জন পুরুষ ও ৬১ জন নারীসহ মোট ১৫৯ জনকে আটক করেছে ৫৮ বিজিবির আওতাধীন বিওপি ক্যাম্প। আটককৃতদের ঝিনাইদহ আদালতে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, আটককৃতরা অধিকাংশই মুসলিম সম্প্রাদায়ের মানুষ। এ ব্যাপারে ৫৮ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল কামরুল আহসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভারতে মাইগ্রেশন হয়ে যাওয়া লোকজনের বসবাসের অসুবিধার কারণে তারা আবার বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। গত এক সপ্তাহে শিশু সহ ১৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এর আগের সপ্তাহে আরো ৪০জন আটক ছিল।’ কিন্তু এর পরেও গত কয়েক দিনে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে শত শত ভারতীয়রা।
এদিকে ভারত থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসার পর বেনাপোল ও দৌলতপুর সীমান্ত থেকে এক পাচারকারীসহ ৫৪ নারী পুরুষ ও শিশুকে আটক করেছে বিজিবি। বুধবার ভোর রাতে পৃথক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করা হয়।
২১ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মোহাম্মদ মনজুর-ই-এলাহী বলেন, গোপন সংবাদে জানতে পারি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া ভারত থেকে বিপুল সংখ্যক লোক বাংলাদেশে প্রবেশ করে শিকড়ি বটতলা মাঠে অবস্থান করছে। এ সময় বিজিবির একটি টহল দল সেখানে অভিযান চালিয়ে ২৫ জন নারী পুরুষ শিশুকে আটক করা হয়।
এখন প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি বাংলাদেশে আবারও একটি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে?
২০১৭ সালে মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করে, এবং বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং কোনভাবেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেবে না। প্রথম কয়েক দিন বিজিবি বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করলেও পরে ভারতের ইন্ধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের প্রবেশ করতে দেয়। এর পর থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়।
শুরু হয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ। নাফ নদী পার হয়ে ছোট ছোট নৌকায় তারা আসতে থাকেন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জুরে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের জেলা কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সম্ভবত দেশে আরও একটি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করতে চাচ্ছেন। বিজিবি চাইলে অনুপ্রবেশকারীদের পুশব্যাক করে ফেরত দিতে পারে। কিন্তু তা না করে তাদের গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। আইনের ফাঁক ব্যবহার করে জামিনে মুক্তি পেলে এসব ভারতীয় এ দেশেই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখন বিজিবির দ্বায়িত্ব হলো গ্রেফতার না করে তাদেরকে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি আরও জোরদার করা।
তারা বলছেন, ভারতীয় সরকারের ওপর মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখাতে প্রধানমন্ত্রী আবারও দেশে ভারতীয়দের প্রবেশধিকার দিয়ে একটি রহিঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে ভারতীয় প্রেমের কথা উঠে আসলেও ভারত সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংদেশকে সহায়তা না করে নতুন এক রহিঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিচ্ছে বলে মানে করছেন তারা।
এদিকে ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের প্রকাশিত ‘ইস্যু ব্রিফ: ইন্ডিয়া’ নামের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, এনআরসির মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে এবং বিশেষত এর দ্বারা ভারতীয় মুসলমানদের রাষ্ট্রহীন করে তোলা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থার নিম্নমুখী প্রবণতার এটি একটি বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, ‘ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার যে ক্রমশ নিম্নমুখী হচ্ছে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিতাড়ন করার এই প্রচেষ্টাই তার অন্যতম উদাহরণ। আগস্ট মাসে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর বিজেপি সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ করেছে, তাতে তাদের মুসলিম বিরোধী মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।
মুসলিমদের বাদ দিয়ে হিন্দু এবং বাছাই করা কিছু সংখ্যালঘুদের সুবিধা করে দিতেই যে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরীক্ষার আয়োজন, বিজেপির ইঙ্গিতেই তা স্পষ্ট।’ বিজেপি ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য একটি ধর্মীয় পরীক্ষা তৈরির লক্ষ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে যাতে হিন্দুরা এবং কিছু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বেঁচে যাবে ঠিকই, তবে বাদ পড়বেন মুসলমানরা।’
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথম এনআরসির একটি খসড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে মাত্র এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়। অথচ আবেদন করেছিল তিন কোটি ২৯ লাখ মানুষ। এরপর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ১৯ লাখ লোককে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়েছে। নাগরিকত্বের সঠিক প্রমাণ দিতে না পারলে এসব লোকের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
রাষ্ট্রহীন হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে পার্লামেন্টের আগামী অধিবেশনে একটি নাগরিকত্ব সংশোধন বিল উঠানোর পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। কিন্তু দেশটিতে বসবাস করা কয়েক কোটি মুসলমানের জন্য এমন কোনো আশ্বাস নেই।
মুসলমানদের আশঙ্কা, রাজ্যটিতে জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করতে পারে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার।