অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
এবার ট্রেন দুর্ঘটনায়ও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেদের অযোগ্যতা, ব্যার্থতা ও সীমাবদ্ধতা আড়াল করতেই প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার দলের নেতারা দেশে কিছু একটা ঘটলেই বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন। তাই অনেকে হাস্যরস করে বলে থাকেন, বিএনপি- জামায়াত যেন সকল রোগের মহৌষধ।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে কোনো আন্দোলন করে সেটাকেও দেখা হয় বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র হিসেবে। সড়কে দুর্ঘটনার প্রতিবাদে যদি কেউ আন্দোলন করে সেটার পেছনেও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র আবিস্কার করেন প্রধানমন্ত্রীসহ তার দলের মন্ত্রী এমপিরা। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ও বৃহস্পতিবার সিরাগঞ্জে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনার পেছনেও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র দেখছেন শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বক্তৃতা করার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বড় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। আজ সিরাজগঞ্জেও ঘটেছে। দেশে যখন কোনো একটি ঘটনা ঘটে তখন এটা পর পর ঘটতে থাকে। এই ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে কারো দূরভিসন্ধি আছে কি না সেটা দেখা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালীন ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমরা এসে এটাকে উন্নত করেছি। দেশে যারা ট্রেন চায়না তাদের চক্রান্তও থাকতে পারে। কারণ, তারা চায়না এটা টিকে থাকুক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিরাজগঞ্জের দুইটি ঘটনাই দুর্ঘটনা। অথচ, এখানেও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র খুঁজছেন শেখ হাসিনা।
সাধারন মানুষ বলছেন, মানুষের কিছু কিছু অভ্যাস আছে যা এক পর্যায়ে এসে মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। তখন মানুষ শত চেষ্টা করেও আর এই অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারে না। বাংলাদেশে বর্তমানে এরকম লোকদের তালিকায় শীর্ষে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা। দেশে কিছু একটা ঘটলেই বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপানো এক সময় আওয়ামী লীগের অভ্যাস ছিল। সেটা এখন তাদের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। এছাড়া সচেতন মহল বলছেন, দেশে একটা কিছু ঘটলে কোনো প্রকার তদন্তের আগেই ঘটনার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র খুঁজেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার দলের নেতারা। কিন্তু তদন্তের পর দেখা গেছে অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। ট্রেন দুর্ঘটনায়ও ক্ষমতাসীনরা দায় এড়াতে পারবেনা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এমনকি রেলমন্ত্রীও এর দায় এড়াতে পারেন না। যদিও তিনি চালকের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন।
জানা গেছে, মন্দবাদসহ একাধিক স্টেশনের সিগন্যাল ত্রুটি ও অস্পষ্টতার বিষয়ে তিন মাস আগেই অভিযোগ করেছিলেন ট্রেনচালকরা। চলমান ডাবল লাইন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের রাখা নির্মাণসামগ্রী, বালি ও ইট রাখার কারণে দূর থেকে সিগন্যাল বাতি দেখা যেত না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী সমিতি চলতি বছরের ৩০ জুলাই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) কাছে সিগন্যাল, সংকেতসহ সেকশনওয়ারি নানা সমস্যা জানাতে বৈঠকের আবেদন জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের (সিআরবি) জিএম কার্যালয়ে সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন জিএম নাসির উদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে সেকশন অনুযায়ী সিগন্যাল ত্রুটির কারণে ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে লিখিত চিঠি দেয়া হয় সমিতির পক্ষ থেকে। জিএমের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে জানানো হলেও মন্দবাগসহ সিগন্যালের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করেনি রেলের সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
সমিতির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, মন্দবাগে প্রবেশের আগেই আউটারে বালির ঢিবির কারণে আপ আউটার সিগন্যাল দেখতে পান না চালক। এ কারণে মন্দবাগ স্টেশনের সিগন্যালের আগে আরো একটি রিপিটার সিগন্যাল বসানোর অনুরোধ করা হয়। অর্থাৎ মূল সিগন্যাল দেখা না গেলে বিকল্প সিগন্যালের ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়। এখন পর্যন্ত সে দাবি বাস্তবায়ন হয়নি।
মন্দবাগ স্টেশন মাস্টার অফিস সূত্রে জানা গেছে, লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় পথিমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে দ্রুতগতির ট্রেন চলাচল করায় অনেক সময় এসব সামগ্রীর জন্য সিগন্যাল বুঝতে সমস্যা হয় চালকদের। বিশেষ করে রাতের বেলায় বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। তাছাড়া রাতে কুয়াশার কারণে প্রতিবন্ধকতা থাকলে সিগন্যাল দেখতেও সমস্যা হয় বলে জানিয়েছে চালক সমিতি।
এ বিষয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, মন্দবাগ স্টেশনে প্রবেশের আগেই আউটার সিগন্যাল দেখতে পান না চালক। সিগন্যালিংয়ের বিভিন্ন ত্রুটি ও এর প্রতিকার চেয়ে আমরা কয়েক মাস আগেই রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা না হলে বাংলাদেশ রেলওয়েতে ট্রেন পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যাবে।
সমিতির অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, বড়তাকিয়া, মুহুরীগঞ্জ স্টেশনের আপ আউটার গাছের জন্য দেখতে পান না চালক। এছাড়া হাসানপুর, গুণবতী স্টেশনের লুপ লাইন থেকে অ্যাডভান্স স্টার্টার সংকেত দেখা যায় না। সিলেট সেকশনের মনতলা, শাহাজীবাজার, কুলাউড়া, মাইজগাঁও স্টেশনের আউটার হোম সিগন্যাল রেলপথ সংলগ্ন গাছের ডালপালার কারণে দৃশ্যমান হয় না।
এজন্য বেশকিছু সেকশনের স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ নির্বিঘ্ন করতে একাধিক রিপিটার সিগন্যাল বসানোর প্রস্তাব করা হয় সমিতির পক্ষ থেকে। এর মধ্যে লাকসাম আপ আউটার থেকে হোম সিগন্যাল দেখা না যাওয়ায় রিপিটার সিগন্যাল বসানো জরুরি বলে জানান সমিতির নেতারা।
এছাড়া ভৈরব আপ আউটার, আখাউড়া-গঙ্গাসাগর সেকশনের ডাউনের এটি বোর্ড থেকে আউটার এবং আউটার থেকে হোমের রিপিটার, শশীদলের ডাউন আউটার, ভানুগাছ স্টেশনের আপ আউটার ও রশিদপুর স্টেশনের ডাউন আউটারে রিপিটার সিগন্যাল বসানোর দাবি জানানো হয়েছিল। পাশাপাশি সিজিপিওয়াই-ফৌজদারহাট সেকশনের এটি বোর্ড থেকে হোম সিগন্যাল দেখা না যাওয়ায় রিপিটার সিগন্যাল বসানোর প্রস্তাব দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি রেলের সংকেত ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর রেলের বিভিন্ন সংগঠন আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তারা যেসব দাবি দিয়েছিল, সেগুলো নিশ্চিতভাবেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় পাঠানো হয়েছে। সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সমাধান করবে।
এখানে বিষয়টা একেবারে পরিষ্কার যে, গত তিন মাস আগে রেল কর্তৃপক্ষকে সমস্যাগুলো কথা জানানো হলেও তারা সমাধানের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার কারণে, সেদিন এত বড় একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং, এই দুর্ঘটনার দায় সম্পূর্ণ সরকারের। অথচ, শেখ হাসিনা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এখানে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র খুঁজছেন।
এরপর বৃহস্পতিবার সিরাজগঞ্জে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা হয়েছে সম্পূর্ণ স্টেশনমাষ্টারের ভুলের কারণে। রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি উল্লাপাড়া স্টেশনের দুই নম্বর লাইন দিয়ে ভেতরে ঢোকার কথা ছিল। কিন্তু স্টেশনমাষ্টার সিগন্যাল বাতি দিলেন এক নম্বর লাইনের। যার কারণে ট্রেনের ৮টি বগি লাইনচ্যুত হয়। সাথে সাথে আগুন ধরে যায় ইঞ্জিনসহ ৪টি বগিতে। অথচ, এখানেও বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র দেখছেন শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন: জামায়াত-শিবির যখন সকল রোগের মহৌষধ!