অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
এছাড়াও রায়ে চারজন পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় দেন। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ মামলার রায়ে সচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ব্যবহার করা হয়।
মামলার সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ৬১ কার্যদিবস শুনানির পর এ রায় ঘোষণা করা হল।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণাকে ঘিরে সোনাগাজী ও ফেনী সদর উপজেলায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬জন আসামী:
- অধ্যক্ষ এস. এম সিরাজ উদ দৌলা। (৫৭)
- নুর উদ্দিন (২০)
- শাহাদাত হোসেন শামীম (২০)
- মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০)
- সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১)।
- জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯)
- হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫)
- আবছার উদ্দিন (৩৩)
- কামরুন নাহার মনি (১৯)
- উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯)
- আব্দুর রহিম শরীফ (২০)
- ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২)
- ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২)
- রুহুল আমিন (৫৫)
- মহিউদ্দিন শাকিল (২০)
- মোহাম্মদ শামীম (২০)
বিদেশি মিডিয়ায় নুসরাত হত্যার রায়
মামলার রায় উঠে এসেছে বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলোতে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, টেলিগ্রাফ, দ্য সান, ডেইলি মেইল, কাতারভিত্তিক আলজাজিরা, যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএন, ফক্স নিউজ, আরব আমিরাতের দ্য গালফ, ভারতের এনডিটিভিসহ বিশ্বের আরও অনেক সংবাদমাধ্যম এই হত্যাকাণ্ডের রায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে।
বিবিসি অনলাইন ‘নুসরাত জাহান রাফি: ছাত্রীর গায়ে আগুন দেওয়া ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড’ শিরোনামে লিড নিউজ করে। একইভাবে ‘বাংলাদেশে নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড’ শিরোনামে তৃতীয় লিড করে আলজাজিরা অনলাইন।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান শিরোনাম করে , ‘১৯ বছরের নারীকে পুড়িয়ে মারায় বাংলাদেশে ১৬ জনের দণ্ড।’
গালফ নিউজ দ্বিতীয় লিডে শিরোনাম করে, ‘কিশোরীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারায় ১৬ জনকে ফাঁসি।’
এই ঘটনা শুরু থেকেই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে আসছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। ঘটনার ছয় মাসের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলো।
নুসরাতের কবরে ফুটন্ত গোলাপ
রায়ের দিনে নুসরাতের কবরে বাঁশের বেড়ায় ফুটন্ত সাদা ও লাল গোলাপের ছবি দেখা গেছে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। রায়ের দিনে ফেসবুকে কবরের পাশে ফুটন্ত গোলাপের ছবি নিয়ে নুসরাতের জন্য জান্নাত কামনা করেছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ‘ফুল ফুটেছে রাফির কবরে, ফেনীর আদালত থাকবে সারাদেশের মানুষের নজরে।’
নুসরাত জাহান রাফিকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করার পর সারাদেশের মানুষ তাকিয়ে ছিলেন বিচারকের আদেশের দিকে। রায় ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ।
নুসরাত মারা যাওয়ার ৬ মাস পর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় প্রতীক্ষারপ্রহর গুণছিলেন নুসরাতের পরিবার। রায় পেয়ে তারা এখন খুশি। রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় নুসরাতের মা বলেন, আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেক খুশি।’ মিডিয়া ও প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি চাই, অতি দ্রুত যেন রায়টা কার্যকর হয়।
পরিবারকে নিরাপত্তার দাবি নুসরাতের বাবার
রায় ঘোষণার পর আদালত কক্ষের বাইরে এসে কেঁদে ফেলেন নুসরাতের বাবা। সাংবাদিকরা তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, আল্লাহর দরবারে অনেক অনেক শুকরিয়া। যে রায় দেয়া হয়েছে এতে আমরা সন্তুষ্ট। আমি সকলকে ধন্যবাদ জানাই। গণমাধ্যম, ডিসি,এসপিসহ প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা, সচেতন নাগরিক যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি আরো বলেন, আমি আমার পরিবারের পূর্ণ নিরাপত্তা দাবি করছি। আমরা যেন নিরাপদে থাকতে পারি সে আশাই করছি।
এসময় নুসরাতের ভাই বলেন, আমার বোনের হত্যার রায়ে আমরা খুশী। কিন্তু এখন আমরা যেন নিরাপদে, কোন বিপদে না থাকি তার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। পরিবার নিয়ে নির্বিঘ্নে থাকতে চাই।
যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে:
মাদরাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার অনুসারীদের দেয়া আগুনে পুড়ে জীবন দিতে হয়েছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী নুসরাতকে। সারা দেশের মানুষ নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল এই রায়ের দিনের জন্য।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফি শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনলে তার মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭শে মার্চ সোনাগাজী থানায় যৌন হয়রানির মামলা করেন।
সেই মামলায় অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর থেকে মামলা তুলে নিতে নুসরাত এবং তার পরিবারের ওপর নানাভাবে চাপ আসতে থাকে।
৬ই এপ্রিল নুসরাত, মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে কৌশলে মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।
পরদিন নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত।
নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ই এপ্রিল সোনাগাজী থানায় মামলা করলেও পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
নুসরাত হত্যার মামলটি প্রথমে সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন তদন্ত করলেও; ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ ওঠায় তদন্তভার নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গত ২৯শে মে পিবিআই ৩৩ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনকে আসামী করে মামলার ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করে।
পরদিন ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট আদালতে থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
১০ই জুন অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, মামলায় গ্রেফতার ২১জন আসামীর মধ্যে পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়।।
তার পরের মাসে ২০শে জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬জন আসামির বিচারকাজ। আসামীদের মধ্যে ১২জন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
৯ই সেপ্টেম্বর ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেয়া শেষ হয়। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।