- ফেসবুকে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে লেখায় পিটুনি
- জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ
- তিন বছরে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী প্রহৃত
- ১৮ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে শিবির সাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে
ভিন্নমত দিলেই মারধর। আবার কখনো তুলে নিয়ে আটকে রাখা। পরে টাকা কিংবা মুঠোফোন হাতিয়ে নেওয়া। এরপর পিটুনি দিয়ে শিবির সাজিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার এমন চিত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিটি ঘটনায় জড়িয়ে আছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নাম।
এসব ঘটনায় জড়িত কাউকে আটক করেনি পুলিশ; উল্টো যাঁদের শিবির সাজানো হয়েছে, তাঁদের থানায় নিয়ে গেছে। যদিওবা পরে শিবির–সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও থেকেছে নির্বিকার। ‘লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে দায়িত্ব সেরেছে। কিন্তু ‘ভয়ে’ বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই অভিযোগ করেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত তিন বছরে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে ২০১৮ সালেই ২২ জন। পাশাপাশি এই বছরগুলোতে আরও ১৮ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে শিবির সাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক দাবি করেছেন, ভিন্নমত কিংবা শিবির সন্দেহে কাউকে মারধরের বিষয়টি তাঁরা সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক একটি চক্র আছে, যারা ধান্দাবাজি কিংবা মুঠোফোন হাতিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো সাধারণ শিক্ষার্থীকে মারধর করে শিবির সাজানোর চেষ্টা করে। এ রকম কিছু যেন আর না হয়, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর রেখেছি।’ আগের ঘটনাগুলোর দায় বর্তমান কমিটি নেবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মারধরের চিত্র
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখি করলেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তাঁদের মধ্যে একজন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ইয়াকুব রাসেল। ভারতের জনপ্রিয় রিয়েলিটি অনুষ্ঠান মীরাক্কেলের সিজন-৯–এ অষ্টম হওয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় ইয়াকুব মারধরের শিকার হন গত বছরের ১২ আগস্ট। তিনি জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে ছাত্রলীগের কয়েকজন ‘ও কমেডি করতেছে’ বলে আবার মারধর শুরু করেন। তাঁর মাথায় ১১টি সেলাই দিতে হয়।
কেবল ইয়াকুব নন, ওই বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মারধরের শিকার হন ২২ জন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মী। বাকিরা সাধারণ শিক্ষার্থী। একইভাবে আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকে লেখালেখি করায় ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন দুই শিক্ষকও।
অন্যদিকে ২০১৬ সালের মে মাস থেকে চলতি বছরের ২৫ জুলাই পর্যন্ত তিন বছরে ১৮ জনকে মারধর করে শিবির সাজিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ। তাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক শিক্ষার্থীও।
মারধরের শিকার একজন এমদাদুল হক। কৃতিত্বপূর্ণ ফলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই শিক্ষার্থী অর্জন করেন ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’। শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে দিনভর আটকে রেখে মারধর করে টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। এরপর ‘শিবিরের কর্মী’ আখ্যা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। বাকি ১৭ জন শিক্ষার্থীর ভাগ্যেও এমনটি ঘটেছিল।
এমদাদুল হক গতকাল বলেন, ‘যাঁরা আমাকে মারধর করেছিলেন, তাঁরা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি। আবার দেখলাম নির্মমভাবে হত্যার শিকার আবরার ফাহাদের জন্য ছাত্রলীগের করা শোক র্যালিতেও তাঁরা অংশ নিল। এটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।’
‘সমান্তরাল প্রশাসন’
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সরকার–সমর্থিত ছাত্রসংগঠন ‘সমান্তরাল প্রশাসন’ গড়ে তুলেছে বলে মনে করেন কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন। তিনি বলেন, এ কারণে হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকছে তাদের হাতে। সেখানে প্রাধ্যক্ষ কিংবা অন্য শিক্ষকদের কোনো কার্যকারিতা থাকছে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেখানে অসহায় হয়ে পড়েছেন। অবক্ষয় থেকে মুক্তির জন্য আপাতত কিছুদিনের জন্য হলেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখা দরকার।
সূত্র: প্রথম আলো