অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কাশ্মীরের হাজার হাজার মানুষ রীতিমত বন্দী তাদের বাড়িতে এবং তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত ও একটি কারফিউ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে।
এমনই অবস্থা এখন ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের যেটি তার বিশেষ মর্যাদা হারিয়েছে, যেই মর্যাদা তাদের এতদিন স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিশ্চিত করেছিলো ভারতীয় সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকেই।
“পুরো উপত্যকা এখন একটি কারাগারের মতো”, বলছিলেন রশিদ আলী, যিনি একটি ঔষধের দোকান চালান শ্রীনগরে।
“বাধা নিষেধ উঠে গেলেই মানুষ রাস্তায় নামবে”।
এখন হাজার হাজার অতিরিক্ত সেনা সেখানকার রাস্তায় যেটি ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্যতম একটি সামরিক জোন।
মার্কেটগুলো, স্কুল কলেজ বন্ধ এবং চারজনের বেশি লোকের কোথাও সমবেত হওয়া নিষিদ্ধ, এমনকি স্থানীয় নেতারাও আটক হয়ে আছেন।
মূলত স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়ার প্রতিবাদে বড় ধরণের প্রতিবাদ হতে পারে আশঙ্কা থেকেই এমন সব ব্যবস্থা নিয়েছে ভারত সরকার।
কাশ্মীর আমাদের
পুরো অঞ্চল থেকেই প্রথম যে কণ্ঠ আসছে এবং বাকীরাও তাতে একমত,আর তা হলো : বিশ্বাসঘাতকতা ও অবিশ্বাস।
“আমাদের স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়ার পরিণতি হবে বিপজ্জনক,” অসিম আব্বাস নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি একথা বলেন।
“এটা আমাদের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলদারিত্বকেই মনে করিয়ে দেয়”।
কাশ্মীরের অনেকেই বিশ্বাস করেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি কাশ্মীরের বাইরের মানুষদের সেখানে জমি কেনার অধিকার দিয়ে সেখানকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যকেই পাল্টে দিতে চায়।
বিশেষ মর্যাদার মাধ্যমে কাশ্মীর সম্পদের মালিকানা ও মৌলিক অধিকারের বিষয়ে নিজেরাই নীতি প্রণয়ন করতে পারতো। এমনকি রাজ্যের বাইরের কারও সেখানে জমি কেনাও নিষিদ্ধ ছিলো।
কাশ্মীরীদের এমনকি নিজেদের সংবিধান, আলাদা পতাকা ও আইন প্রণয়নের স্বাধীনতা ছিলো।
শুধু পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে।
কিন্তু এখন সব পাল্টে গেছে কারণ বিজেপি মনে করছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে জম্মু কাশ্মীরের আর আলাদা মর্যাদার দরকার নেই।
অথচ কাশ্মীরের মানুষ তাদের বিশেষ অধিকার হারানোর বিষয়ে আগে থেকে জানতেই পারেনি।
যখন পর্যটকদের চলে যেতে বলা হলো ও হিন্দু তীর্থযাত্রীদের যাত্রা বাতিল করা হলো তখন অনেকে ভেবেছিলো জঙ্গি হামলার হুমকির কথা।
তখনো জানা যায়নি যে সরকার আর্টিক্যাল ৩৭০ বাতিলের পরিকল্পনা করেছে।
একই সাথে ভাগ করা হয়েছে কাশ্মীরকে।
এসব কারণেই অবিশ্বাস থেকে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে অনেকে কাশ্মীরীর মনে।
মঙ্গলবার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।
“ভারত ফিরে যাও, কাশ্মীর আমাদের” এমন শ্লোগান হয়েছে সেখানে, যদিও কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
অসিম আব্বাস বলছেন, “মনে হচ্ছে পাথরের যুগে ফিরে গেছি। বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে আমাদের”।
“কাশ্মীরিরা ক্ষুধার্থ নাকি মরে গেছে তা নিয়ে তাদের চিন্তা নেই”।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বলেন, “কাশ্মীর তার স্বাধীনতা হারিয়েছে ও ভারতের দাসত্বে চলে গেছ বলেই মনে হচ্ছে”।
বারামুলার অধিবাসী আব্দুল খালিক নজর বলেন, “এটা তারা পনেরই অগাস্টের পরই করতে পারতো। সামনে আমাদের ঈদ”।
কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাস্তাঘাট এখনো আটকে রাখা হয়েছে। চেকপয়েন্টগুলোতে পুলিশ ও সশস্ত্র আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। চলাচল খুবই সীমিত।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে বিধিনিষেধ কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবাও চালু হবে।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের স্যাটেলাইট ফোন দেয়া হয়েছে।
কাশ্মীরের বাইরে থাকা কাশ্মীরিরা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা।
তিনি বলছেন, “আমি জানিনা আমার পরিবার কেমন আছে”।
পর্যটক ও কাজ করতে আসা শ্রমিকরা সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য রীতিমত সংগ্রাম করছেন।
টিকেট বুকিংয়ের জন্য ইন্টারনেট নেই। কেউ কেউ বিমানবন্দর ও বাস স্টেশনে পৌছাতে পারলেও লোকজন পাননি।
কেউই জানেনা কখন ও কিভাবে এ পরিস্থিতির অবসান হবে।
কেউ কেউ উল্লাস করছে জম্মু ও কাশ্মীরকে এক করায়।
আবার কেউ প্রশ্ন করছে, “এতোই যদি আনন্দের ঘটনা হয় তাহলে সব বিচ্ছিন্ন কেন এবং মৌলিক অধিকারই বা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে কেনো?”
১৪৪ ধারা ভেঙ্গে কাশ্মীরে বিক্ষোভ
বুধবার ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শ্রীনগরের রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ।
আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মধ্যেই কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় বুধবার বিক্ষোভ হয়েছে। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে শ্রীনগরে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন কাশ্মীরি জনগণ।
এদিকে কাশ্মীরি জনগণের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে ছয় কাশ্মীরি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কাশ্মীরি কয়েকটি মিডিয়ার বরাতে ডন অনলাইন জানিয়েছে, বুধবার বিক্ষোভরত কাশ্মীরিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় ভারতীয় বাহিনী। এতে ছয়জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ শতাধিক রাজনীতিক, উপদেষ্টা ও স্বাধীনতাপন্থী নেতাদের।
ডন অনলাইন জানিয়েছে, গুলিবিদ্ধ ওই ছয়জনকে শ্রীনগর হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন শতাধিক মানুষ। শ্রীনগরে গুলি চালানোর বিষয়টি ভারতীয় কর্মকর্তারা রয়টার্সের সাংবাদিকের কাছে স্বীকার করেছেন।
বিক্ষোভ ঠেকাতে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে হিমালয় অঞ্চলটির সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার সোমবার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের ঘোষণাকে সামনে রেখে কাশ্মীরের ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
এই মুহূর্তে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকীকৃত এলাকায় পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্য মিলিয়ে সেখানে ৭ লক্ষাধিক নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে ভারত।
অস্থায়ী কারাগার বানানো হয়েছে হোটেল, গেস্ট হাউস, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ভবনকে। কাশ্মীরের পুরো উপত্যকাটি যেন পরিণত হয়েছে একটি কারাগারে।