শাহমুন নাকীব
আমি মাঝে মাঝে ভাবি সেই ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রাসূল আরবদের মত সংঘাত প্রিয় জাতিকে শান্তিপূর্ণ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তুললেন! যে জাতি ছিল ততকালীন সময়ের সবচেয়ে হিংস্র ও অসভ্য জাতি। তাদের মাঝে সভ্যতার লেশটুকুও ছিল না। আর পড়াশুনা কিংবা শিক্ষা তো দূর কি বাত!
শিক্ষা থাকলে সেই জাতিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে না হয় সভ্য করা যায়! কিন্তু আরবদের শিক্ষার লেশ মাত্রও ছিল না। অথচ সময়ের পরিক্রমায় তারা ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়।
অন্যদিকে, আমরা বর্তমান আধুনিক যুগে বসবাস করে, পড়াশুনায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে অমাানুষ বনে যাচ্ছি। গত ১৫ দিনে দেশের শেয়ার বাজার থেকে সরকারিভাবে ২৭ হাজার কোটি টাকা গায়েব! আর গতকাল পত্রিকা মারফত দেখলাম, পুলিশের একজন ডিআইজি ঘুষের ৮০ লক্ষ টাকাসহ গ্রেফতার! এইসব চুরি চামারি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিতরাই করছে। আমাদের দেশে শিক্ষার হার যত বাড়ছে, দূর্নীতি, চুরি-চামারির সংখ্যাও যেন দিন দিন বেড়ে চলেছে!
অন্যদিকে আরবরা শিক্ষিত না হয়েও কীসের বলে এতোটা সভ্য হয়েছিল। এর পিছনে একমাত্র কারণ হল, তারা একজন অনুকরণীয় নেতা পেয়েছিল। যে নেতা শুধু কথায় নয়, কার্যত প্রমাণ করে গেছেন। কথায় এবং কাজের সাথে মিল থাকায় তিনি একটি অসভ্য জাতির নেতা হতে পেরেছিলেন। সেই সাথে সেই অসভ্য জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। চলুন দেখে নেই নেতা হিসেবে আল্লাহর রাসূলের কিছু বেসিক গুণাবলি। যা তাঁকে নেতা হিসেবে সফল হতে সহায়তা করেছিল।
আল্লাহর রাসূল তাঁর দুনিয়ায় আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন- ‘আমাকে পাঠানো হয়েছে কেবল নৈতিকতা এবং সদাচারণকে প্রতিষ্ঠা ও সমুন্নত করার জন্যই।’ (মুসনাদে বাজ্জার- ৮৯৪৯)
এবার তাহলে চলুন দেখে নেওয়া যাক, নেতা এবং মানুষ হিসেবে আল্লাহর রাসূলের গুনাবলিসমূহ। আর এই গুনাবলিসমূহ জানব আল্লাহর রাসূলেরই সাহাবীদের বর্ণনার মাধ্যমে।
আনাস রা. বলেন- আমি আল্লাহর রাসূলের কাছাকাছি ১০ বছর থাকার সুযােগ পেয়েছি। আমি এই সময়ের মধ্যে তাকে বিরক্তি বা রাগের কারণে একবার উফ শব্দটা উচ্চারণ করতেও শুনিনি। এমনকী আমি কী করেছি বা কেন করেছি- এমন ধরনের প্রশ্নও তিনি করতে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১১৯৭৪)
উপায় থাকত, তাহলে রাসূল সা. সবসময় সহজটাকেই বেছে নিতেন; যদি না তাতে কোনাে পাপের সম্ভাবনা থাকে। যদি সহজ কাজটিতে গুনাহর কোনাে সম্ভাবনা থাকত, তাহলে তিনি ভুলেও সেটা করার কথা ভাবতেন না। রাসূল কখনাে কারও ওপর ব্যক্তিগত প্রতিশােধ নিতেন না। আল্লাহ যদি কাউকে অমান্য করায় কথা বলতেন, তাহলেই শুধু রাসূল ; তাকে অমান্য করতেন; তবে সেক্ষেত্রেও তার আচরণ ছিল বিনম্র। রাসূল নিজে কখনােই কাউকে সরাসরি তাঁর হাত দিয়ে মারতে যাননি। তাঁর স্ত্রী কিংবা দাসদের গায়েও হাত তােলেননি। তবে তিনি আল্লাহর হুকুমে দ্বীনের স্বার্থে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।’ (মুসলিম : ২৩২৭)
হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূল সা. -এর সাথে হাঁটছিলাম। তাঁর শরীরে সে সময় একটি মােটা চাদর পেঁচানাে ছিল। এমন সময় একজন আরব এত জোরে তার চাদরটি টান দিলাে যে তার কাঁধের একটি অংশ অনাবৃত হয়ে গেল। আমি এভাবে চাদরটি টানার দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। আরব লােকটি রাসূল সা.-কে বলল- “ও মুহাম্মাদ! আল্লাহ তােমায় যে সম্পত্তি দিয়েছেন, তার থেকে আমাকে কিছু ভাগ দাও।” রাসূল সা. তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাসলেন আর ওই আরবকে কিছু দান করে দিতে বললেন।’ (বুখারি : ৩১৪৯)
হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেছেন- আল্লাহ নিজে কোমল, তাই তিনি কোমলতা, নম্রতা ও বিনয় পছন্দ করেন । বিশেষ করে যারা কারও কঠোর আচরণের প্রতিক্রিয়ায় নম্রতা দেখাতে পারে, তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার। (মুসলিম : ২৫৯৩)।
‘হজরত জারির রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. বলেছেন- নম্রতার জন্য আল্লাহ তায়ালা যে পুরস্কার বরাদ্দ রেখেছেন, তা আর অন্য কোনাে কিছু দিয়েই পাওয়া যাবে না। যখন আল্লাহ তাঁর কোনাে বান্দাকে অতিরিক্ত পছন্দ করেন তখন তাকে কোমলতা দান করেন। যেসব পরিবারে নম্রতা কম থাকে তারা অন্যসব নেকি থেকেও বঞ্চিত থাকে।’ (তাবরানি : ২২৭৪)।
‘হজরত আব্দুল্লাহ বিন হারিস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলের এর মতাে হাসিমুখে আর কাউকেই থাকতে দেখিনি।’ (তিরমিজি : ৩৬৪১)
‘হজরত আয়েশাকে রা. একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, বাড়িতে থাকলে রাসূল কী করতেন? আয়েশা ও উত্তরে বলেন, নবিজি বাড়িতে থাকলে বাড়ির লােকদের সাহায্য করতেন। যখন সালাতের সময় হতাে, তখন তিনি অজু করে সালাতের জন্য বেরিয়ে যেতেন। (মুসনাদে আহমদ : ২৪২২৬)
হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলের ব্যবহার ও আচরণ ছিল সবার চেয়ে উত্তম। আমি আবু উমায়ের নামক একজনকে ভাই হিসেবে দত্তক নিয়েছিলাম। তার একটি অসুস্থ পাখি।
ছিল- যার নাম ছিল নাঘির। রাসুল , সবসময়ই আমার সেই পালিত ভাই ও তার পাখির সাথে খেলা করতেন। আমার ভাইটিকে দেখলেই রাসল ড. প্রশ্ন করতেন- হে আবু উমায়ের, তােমার নাঘিরের কী খবর? ও কেমন আছে?’ (বুখারি : ৬২০৩)।
এগুলোই ছিল আল্লাহর রাসূলের বেসিক গুনাবলি। ১৪০০ বছর আগের সেসব ঘটনা আজও এভাবে লিপিবদ্ধ থাকার কারণ একটাই, মানুষ যেন আল্লাহর রাসূলের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সে অনুযায়ি নিজেকে তৈরী করতে পারে। নিজেকে জাতির যোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের! বর্তমান বাংলাদেশে এমন একজনও নেতা পাওয়া যাবে না, যার হাত ধরে দূর্নীতিগ্রস্থ বাংলাদেশ দূর্নীতি মুক্ত হয়ে উঠবে। আজ নেতারাই যে সবচেয়ে বেশি দূর্নীতিগ্রস্থ! অথচ আল্লাহর রাসূলের এই অনুপম শিক্ষা গ্রহণ করে পশ্চিমা বিধর্মীরা আজ উন্নতির চূড়ান্ত শিখায় পৌছে গেছে! আর মুসলিম দেশগুলো ধুকে ধুকে মরছে! কারণ মুসলিম দেশেগুলোতে মুসলিম আছে কিন্তু আল্লাহর রাসূলের শিক্ষার বাস্তবায়ন নেই!