খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র কুমারের মেয়ের জামাই ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজন কর্মকার মারা গেছেন। তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে শনিবার দিবাগত রাত ৪টার দিকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। রাজনের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
ডা. রাজনের মামা সুজন কর্মকার সাংবাদিকদের বলেন, তার ভাগ্নের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এজন্য সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। পরিবারের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রোববার সন্ধ্যায় থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়েরসহ ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা হয়।
এর আগে ডা. রাজনের সহকর্মীদের কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে রাজনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ময়নাতদন্ত করতে চান না। তাদের দাবি, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।
ডা. রাজন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বড় মেয়ে কৃষ্ণা রানী মজুমদারের স্বামী। কৃষ্ণা রানী বিএসএমএমইউ’র জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। রাজনের বাবা সুনীল চন্দ্র কর্মকার ও মা খুকু রানী কর্মকার। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার কর্মকার বাড়ি।
রাজনের পরিবার ও সহকর্মীরা যুগান্তরকে জানান, তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের মেয়ে কৃষ্ণা রানী মজুমদারের সঙ্গে রাজনের বিয়ে হয়। তারা ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন।
শনিবার রাত ১২টার দিকে মোহাম্মদপুরের একটি হাসপাতালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শেষে বাসায় ফেরেন। রাত পৌনে ৪টার দিকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন।
রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে তাঁর মুঠোফোনে পুত্রবধূ কৃষ্ণার ফোন আসে। রাগী স্বরে কৃষ্ণা তাঁকে বলেন, ‘আমি আপনাকে আর আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াব।’ বলেই ফোন কেটে দেন। খুকু রানী এরপর ছেলে রাজনকে ফোন করেন। রাজন বলেন, ‘মা তুমি চুপ কর। তুমি কোনো কথা বলিও না’। রাজন এটা বলেই ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি অনেকবার ছেলেকে ফোন করেও পাননি। পরে ভোর চারটার দিকে তাঁর ছোট ছেলে রাজিবের মুঠোফোনে রাজনের মৃত্যুর খবর আসে।
রাজনের ছোটভাই রাজিব কর্মকার বলেন, ভোর চারটার দিকে তাঁর ভাইয়ের শ্যালিকা মুন্নি তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘নিকটাত্মীয় কেউ ঢাকায় থাকলে হাসপাতালে পাঠান’। এরপর মুন্নী তাঁদের আত্মীয় রাজেশ মজুমদারকে ফোনটি দিলে তিনি রাজীবকে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানান।
রাজনের মা ও ভাই জানান, ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক ভাবে রাজনের সঙ্গে কৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তাঁদের দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। রাজনের গায়ে হাতও তুলতো কৃষ্ণা। প্রায় দেড় বছর আগে কৃষ্ণার প্রচন্ড মারধরে রাজনকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়। তখন তাঁকে আইসিইউতে নিতে হয়েছিল। খুকু রানী কর্মকার দাবি করেন, তাঁর ছেলের বউ পরিকল্পিতভাবে তাঁর ছেলেকে হত্যা করেছে। তিনি এর বিচার চান।
এদিকে এক বছর আগেও রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় তার স্ত্রী অর্থাৎ খাদ্যমন্ত্রীর মেয়ে কৃষ্ণা। রাজনের সহকর্মী বিএসএমএমইউ’র সহকারী প্রক্টর ও নিউরোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আহসান হাবীব যুগান্তরকে বলেন, ‘এক বছর আগে রাজনকে গুরুতর অবস্থায় একটি স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে আমি গিয়ে দেখি তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমি দ্রুত বিএসএমএমইউ’র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ফোন করে অন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে স্থানান্তর করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে না দেখালে তখন তাকে বাঁচানো যেত না। তখন তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। ওই সময় তার স্ত্রী কৃষ্ণাকে আমি বারবার বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।’
রাজনের সহকর্মী বিএসএমএমইউ’র নিউরোলোজি বিভাগের চিকিৎসক শাহ নেওয়াজ বারী বলেন, ‘এর আগেও রাজনের সঙ্গে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণে আমাদের সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তাই এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, রাজন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক ছিল। সে অত্যন্ত বিনয়ী এবং নমনীয়। শনিবার সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে। এ অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটেছে। এ নিয়ে পরিবার এবং সহকর্মীরা মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে লাশ ময়নাতদন্তের দাবি জানায়। সেক্ষেত্রে আমি তাদের দাবির পক্ষে মত দিয়েছি। কারণ ময়নাতদন্ত ছাড়া মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।’
এ বিষয়ে শেরেবাংলানগর থানার পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসক রাজন কর্মকারের মৃত্যু নিয়ে তার পরিবার বলছে, ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে সন্দেহমূলকভাবে তারা একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর ভিত্তিতে রাজনের লাশের ময়নাতদন্ত হচ্ছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বোঝা যাবে, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু, না অন্য কিছু। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।’
এদিকে রাজনের স্ত্রী ডা. কৃষ্ণা রানী মজুমদারের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
তথ্যসূত্র: যুগান্তর ও প্রথম আলো