পর্যবেক্ষণ চলছে বিএনপিতে। কেন রাজনীতির ইতিহাসে লজ্জার হার? ক্ষমতায় যেতে না পারলেও মোটা অংকের সিট পাওয়ার ইঙ্গিত ছিলো। পরিবর্তনের আভাস ছিলো। জয়-পরাজয়ে করণীয় ঠিক করা ছিলো। খালেদার নির্দেশে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ফুরফুরে মেজাজেই নির্বাচনের মাঠে ছিলো। কিন্তু নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপির কোনো গোপনীয় সিদ্ধান্তই আর গোপন থাকেনি। বিএনপির সব সিদ্ধান্তই ক্ষমতাসীনদের সংসারে চলে গিয়েছে! যার ফলে নির্বাচনের পরবর্তী কর্মসূচিতেও যেতে পারেনি বিএনপি। হতাশায় নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় কেন্দ্রীয় নেতারাও!
এই মুহূর্তে দলের কী করণীয় তাও নির্ধারণ করতে পারছেন না। আগামীর ভূমিকা নিয়ে দলের স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্তই এখন আর চাপা রাখতে পারছে না। দলের ভেতরে থেকে যে কেউ ক্ষমতাসীনদের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারই ভিত্তিতে নির্বাচনের পর থেকে বিএনপির নানা পর্যবেক্ষণে ঘরের শত্রুকেই চিহ্নিতের চেষ্টা চলছে।
এ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের দুই সদস্যের মাধ্যমে জানা যায়, দলেই ক্ষমতাসীন পর্যায়ের এক শীর্ষ নেতার নাম। যিনি তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর! গ্লোবাল পলিটিক্সও যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়। ক্ষমতাসীনদের আমলেই যার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার আলাদিনের চেরাগের মতোই আলো ছড়াচ্ছে! রহস্যময় ব্যক্তি হিসেবেই দলে যার পরিচয়। তিনি হলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু!
আওয়ামী লীগের সংসার থেকে বিএনপির পতাকায় আশ্রয় নিলেও মিন্টু স্বার্থবাদী চরিত্রেই আছেন বলে খোদ বিএনপির ভেতর থেকেই অভিযোগ উঠেছে। তারেক জিয়া ও ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়ার শঙ্কায় অনেক কিছু জেনেও সাহস করে কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। কারণ ক্ষমতাসীনদের থেকে লাভবান হচ্ছেন মিন্টু আর মিন্টুর মাধ্যমেই বড় ধরনের অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাচ্ছেন তারেক জিয়া!
পরিচয় গোপন রেখে বিএনপির দুই নীতিনির্ধারক আমার সংবাদকে বলেন, এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণটা ছিলো আন্দোলনের অংশ। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিএনপির আন্দোলনের প্ল্যান ছিলো। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাজয় ঘটলে নির্বাচনের পরপর কী করণীয় ছিলো তাও ঠিক করা ছিলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও একটা সবুজ সংকেত ছিলো। শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ বিএনপি এর কোনোটাই করতে পারেনি। হতাশাগ্রস্ত হন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। নিষ্ক্রিয় হয়ে যান মাঠপর্যায়ের নেতারা।
তাদের অভিযোগ এর পেছনে নাটের গুরু হয়ে কাজ করেছেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তারেক জিয়ার নির্দেশনা, বিদেশিদের সংকেত এবং দলের গোপন সিদ্ধান্ত সবই ফাঁস হয়ে যায়। এর পেছনে মূল কারণ ছিলো মিন্টুর ব্যবসা। তার ব্যবসার মাঠ ধরে রাখার জন্য জেল থেকে খালেদার নির্দেশ, বিএনপির মাস্টার প্ল্যান সবই সময়ের আলোকে ক্ষমতাসীনদের ঘরে চলে যায়।
ওই দুই নীতিনির্ধারকের ভাষ্য, বিএনপির বিরোধী দলে থেকে কোনো আন্দোলন ইস্যুই জমাতে পারেনি এই দীর্ঘ সময়ে। বিডিয়ার বিদ্রোহ, রিজার্ভ চুরি, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে বিএনপি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ! শক্তিশালী ইস্যু নিয়ে কথা বলে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
এছাড়াও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে বয়স্কদের বাদ নিয়ে নতুন ও তরুণদের দিয়ে দেশ চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তখন থেকেই বিএনপিতেও মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটিসহ শীর্ষ পদের রদবদলের আওয়াজ উঠে। তখন থেকেই আবদুল আউয়াল মিন্টু নতুন জাল বুনছে। তারেক জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ছেলে তাবিথ আউয়ালকে বানাতে চাইছে বিএনপির মহাসচিব। এ নিয়ে গত দুদিন বিএনপি পাড়ায়ও চলছে কানাঘুষো। যেহেতু তারেকের কাছে আবদুল আউয়াল মিন্টু অনন্য স্থানে। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন দীর্ঘ সময় কারাগারে।
নির্বাচনের পরে মুক্তির ইঙ্গিত থাকলেও যদি আবদুল আউয়াল মিন্টুদের গুপ্ত চিন্তা থাকে তাহলে রাজনৈতিকভাবে খালেদার মুক্তি আরও দীর্ঘায়িত হবে বলেও বিএনপির বড় একটি অংশের ভাষ্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিন্টু এখন বিএনপিতে আওয়ামী লীগের চর হয়েই কাজ করছেন। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েও শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে যান তিনি।
নির্বাচনে আবদুল আউয়াল মিন্টুর হঠাৎ ইউটার্ন এবারই প্রথম না। এর আগেও তিনি বিএনপির সঙ্গে এমন আচরণ দেখিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে তার প্রার্থী হওয়ার কথা। দীর্ঘদিন ধরে তাকে ঘিরে চলে ক্যাম্পেইন, তিনিও মাঠে ছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য ভুলে তার নমিনেশন পেপার বাতিল হয়ে যায়। তবে আশ্চর্জজনকভাবে মনোনয়ন টিকে যার তার ছেলে তাবিথ আউয়ালের। ওই ভুলের ঘটনাকে অনেকেই ইচ্ছাকৃত বলে দাবি।
এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ফেনী ৩ ও ২ থেকে বিএনপির নমিনেশন পান তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে সরে দাঁড়ালেন। এরপর ২ আসন থেকে মনোনয়ন পান রফিকুল আলম মজনু এবং ৩ আসন থেকে বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল লতিফ জনি। কিন্তু কয়েকদিন পর জনির নমিনেশনও বাতিল হয়ে যায়! অবশেষে সেই আসনে ঠাঁই পায় তারই ছোট ভাই আকবর হোসেন। তখন ফেনী থেকে বিএনপির কয়েকজন নেতাকে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিতে দেখা যায় এমন… সবই মিন্টু ভাইয়ের খেলা! তার ভাইয়ের আসনে গোপনে জাপা নেতাকে সমর্থন দেন বলেও স্থানীয় রাজনীতি থেকে অভিযোগ আছে।
বিএনপি নেতাদের দাবি, এবারের ভোটে তীরে এনে বিএনপিকে তলিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা এই নেতা! দীর্ঘ ২০ বছর আওয়ামী লীগ করেছেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদকও। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসায় তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। অনেকে মনে করেছেন বিএনপির রোষানল থেকে বাঁচতে খোলস বদলে দলে যোগ দিলেও মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগই থেকে গেছেন। সব সময় দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছেন। যে কারণে আওয়ামী লীগ তাকে পেছন থেকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। এখনো তার আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া রয়েছে। আবার আত্মীয়তার সূত্রেও রয়েছে গভীর যোগসূত্র। ছোট ছেলে তাফসির বিয়ে করেছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা গওহর রিজভীর মেয়েকে।
আত্মীয়তার চেয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ে আলোচনায় ঠাঁই পেয়েছে তা হচ্ছে- আওয়ামী লীগের সময়ে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির অন্য নেতারা যখন পালিয়ে বাঁচতে পারছেন না। তখন মিন্টুর ব্যবসা যেন জোয়ারের পানির মতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
আবার তার ছেলে তাবিথ আউয়ালের বাফুফের সহ-সভাপতি পদ নিয়েও রয়েছে নানা রকম কানাঘুষা। বিএনপির নেতাকর্মীদের যখন বিভিন্ন পদ থেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনে জিতলেও অনেক মেয়রকে চেয়ারে বসতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। ক্রীড়াঙ্গনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যদলের লোক খোঁজার জন্য বাটি চালান দিতে হয়। কিন্তু তাবিথের চিত্র পুরাই ভিন্ন। আয়েশের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
গত কয়েক বছরে নতুন করে ১৫-২০টি নতুন ব্যবসা খুলেছেন। এর কোনোটিতেই সরকারের থাবা পড়েছে বলে শোনা যায়নি। যেখানে বিএনপির নেতারা ঘর-বাড়িতে থাকতে পারেন না সেখানে মিন্টুদের প্রতিদিনই বাড়ছে সম্পদের পাহাড়। অনেকেই মনে করছেন, এর সবই সম্ভব হচ্ছে এক হাতে তারেক জিয়াকে রাখা অন্য হাতে আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হওয়ায়। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য গতকাল আবদুল আউয়াল মিন্টুকে অনেকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।
সূত্র: আমার সংবাদ