অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্ধারিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ দিয়ে বাংলাদেশে এখন একটি ভয়াবহ দমনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে যা নির্বাচনের গ্রহনযোগ্যতাকে অনেকটুকু নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষও সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর তার আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে এই অভিমত প্রকাশ করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের সহিংসতার অভিযোগ তদন্ত করা এবং প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা।
৩৭ পৃষ্ঠার রিপোর্ট, যার শিরোনাম ছিল “Creating Panic”; Bangladesh Election Crackdown on Political Opponents and Critics “(ভয়ের পরিবেশ তৈরি এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিরোধী গোষ্ঠী ও সরকার সমালোচকদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে)’। সাম্প্রতিক সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের সরকার বিরোধী গোষ্ঠীর উপর বিপজ্জনকভাবে নজরদারি বাড়িয়েছে এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে বাঁধার সৃষ্টি করছে ফলে সর্বত্র একটি আতংকের পরিবেশ বিরাজ করছে। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীর উপর নিয়মিত গতিতে হামলা চালানো হলেও কর্তৃপক্ষ তা বন্ধে কোন উদ্যেগ নিতে পারছেনা। তাছাড়া সরকার দলীয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও পুলিশ তাদেরও গ্রেফতার করতে পারছেনা।
হিউম্যিান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এডামস এই প্রসংগে বলেন, নির্বাচনকে যদি গ্রহনযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন করতে হয় তাহলে নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে তাদেরকে কেউ সরকারী দলের সহযোগী বা আজ্ঞাবাহক মনে করার সুযোগ না পায়। এবারের নির্বাচনে সহিংসতার সবচেয়ে বেশী শিকার হয়েছে বিরোধী দল কিন্তু উল্টো তাদেরকেই আবার নিরবিচ্ছিন্নভাবে হয়রানি করছে প্রশাসন।
রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে ৫০ টিরও বেশি সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে এবং আদালতের রেকর্ড এবং আরো বেশ কিছু শ্রেণী ও গোষ্ঠীর মতামত ও প্রাপ্ত তথ্যগুলোর বিশ্লেষনের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়েছে যাতে বিরোধী ও প্রতিবাদকারী ব্যক্তিদেরকে আটক করা, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র, যুব ও অন্যন্য অংগ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সহিংসতা ও ভীতিকর সৃষ্টির ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, এটাও প্রতিবেদনে উঠে আসে যে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশনের মত প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে ভুমিকা পালন করতে পারছেনা। এমনকি নির্বাচনে প্রার্থী মনোয়নন, যাচাই বাছাই বা আপীল রায় দেয়ার ব্যপারেও তারা নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও উচিত তাদের কর্মী ও সমর্থকদের সহিংসতার পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ভুমিকা পালন করা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের অনুসন্ধানে আরো পেয়েছে যে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ খুবই নির্দয়ভাবে সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে বিরোধে জড়াচ্ছে এবং এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সাংবাদিকরা অভিযোগ করে বলছেন যে, সরকার সম্প্রতি যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ) প্রণয়ন করেছে তা কার্যকরভাবে অনুসন্ধানীমুলক সাংবাদিকতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ঝুঁকিপূর্ণ গ্রেফতারের হুমকি থাকায় এখন নাগরিকেরাও বেশ চাপের মধ্যে রয়েছেন।
প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দেয়ার সাথে সাথেই প্রচারণা শুরু হয়। এর পরপরই দেশজুড়ে সহিংসতাও শুরু হয় এবং বেশিরভাগ সহিংসতাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টকে লক্ষ্য করেই হয়েছে। এসব হামলার অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ তা গ্রহন করতে চায়না। উল্টো বিরোধী দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রধান দলগুলোর প্রত্যেকেই সহিংসতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেছে। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বিরোধী দলের সাথে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন সাধারণত পদক্ষেপ নিতে অনাগ্রহ দেখায়, এমনকি এই ঘটনাটি স্বীকার করতেও অস্বীকার করে। বিএনপির প্রার্থী মো: আসাদুজ্জামান হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, ১১ ই ডিসেম্বর তারিখে ঝিনাইদহে তার প্রচারণা চলাকালে তিনি বারবার কমিশনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। “তারা প্রাপ্তি স্বীকার করে, কিন্তু কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা।
১৬ ডিসেম্বর তারিখে আবদুল মঈন খানসহ বিএনপি প্রার্থীদের উপর সিরিজ হামলার সংবাদ প্রচার গনমাধ্যমে জানিয়েছে। আফরোজা খানম রিতা ১২ ডিসেম্বর ও বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহর ১১ ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হামলা শিকার হন। বিএনপির আরেক প্রার্থী রোমানা মাহমুদ ১৫ ই ডিসেম্বর পুলিশ ও তার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হন।
১৪ ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন দলের অভিযুক্ত সদস্যরা ঐক্য ফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেনকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালায়। যদিও তিনি অক্ষত ছিলেন কিন্তু তার সাথে থাকা আরো অন্তত ২৫ জন এই হামলায় আহত হন।
ডেইলি স্টারের তথ্যনুযায়ী, ১৭ ডিসেম্বর অবধি কমপক্ষে ২৬ জন বিরোধীজোট প্রার্থীকে আক্রমণ করা হয়েছে, ১৩ জন বিরোধী প্রার্থী আহত হয়েছেন, ছয়জন নতুন করে গ্রেপ্তার হয়েছে, এবং ৮৭৫ জন বিরোধী সমর্থক আহত হয়েছেন। একই সময়ে দুই আওয়ামী লীগ প্রার্থীও এবং ৭৫ জন কর্মী আহত হয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছেন, “নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতার মুল লক্ষ্য আওয়ামী লীগ।
এই সহিংস পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার প্রতিদিন শত শত বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে যাচ্ছে। বিএনপির হিসেবে নির্বাচনের আগে থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রায় ৩ লাখ বিরোধী নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আর কয়েক হাজার মানুষকে এরই মধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে। সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় ১৮ ডিসেম্বর থেকে দেশজুড়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, যেহেতু বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইসিসিপিআরে স্বাক্ষরকারী দেশ তাই তার উচিত অবিলম্বে সব ধরনের নির্বিচারে আটক অভিযান বন্ধ করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার বিধান করা।
বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন হলেও দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো বিদেশী পর্যবেক্ষকদের এই নির্বাচন দেখার সুযোগ দেয়া হচ্ছেনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই জানিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে কোন প্রতিনিধি পাঠাবেনা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার ভিসা না দেয়ায় মার্কিন পর্যবেক্ষকরাও দেশটিতে প্রবেশ করতে পারছেনা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের সরকার সহযোগিতা না করায় তাদের কোন সংগঠন বা সংস্থার প্রতিনিধি আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষন করতে বাংলাদেশে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
তথ্য সূত্র: হিউম্যিান রাইটস ওয়াচ