মুসাফির রাফি
ছাত্রদের আন্দোলন কি দমে গেছে? সরকার কি আগের সব আন্দোলনের মত এটাকেও ম্যানেজ করে ফেললো? কারও কারও মুখে এমন কথা শুনলাম। আসলেই কি আন্দোলন দমে গেছে। বুকের ভেতরের দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন কি আর এত সহজে নেভানো যায়।
একটা বিষয় সবার বোঝা জরুরী আর তা হলো ছাত্রদের এই আন্দোলন রাজনৈতিক কোন আন্দোলন নয়। এদের দিয়ে অনির্দিষ্টকাল আন্দোলন হওয়ার কথাও নয়। এই ছাত্র আন্দোলনের কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই, নেতৃত্ব নেই, বাজেট নেই, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা নির্দেশনাও নেই। ছোট ছোট কিশোর কিশোরীরা এত বড় একটা শহরকে এক সপ্তাহরও বেশী সময় নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল, এর চেয়ে বড় অর্জন আর তাদের দিক থেকে আর কি হতে পারে? একটা গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রশাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো।
ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ট্রাফিক সপ্তাহ উদ্বোধনের সময় বলেছিলেন এই ছাত্র আন্দোলন পুলিশের নৈতিক ভিত্তিকে জাগিয়ে তুলেছে। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে সবচেয়ে শক্তিশালী যে উপাদান, সেই জনগনকে তারা জানিয়ে দিয়েছে যে সরকার পরিচালনার আড়ালে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা কিভাবে একটি দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে।
একজন মন্ত্রী আইন মানে না, তার ড্রাইভার রাস্তায় রং সাইড দিয়ে গাড়ি চালায়, পুলিশের ডিআইজির গাড়ির কাগজ থাকেনা, পুলিশ ড্রাইভারদের নিজেদের ইলাইসেন্স থাকেনা, অর্থাৎ একটি সিভিল প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনী যারা মূলত রাষ্ট্রকে সঠিক লাইনের উপর রাখে, তারা নিজেরাই বছরের পর বছর নৈরাজ্য আর অরাজকতারই অনুশীলন করে গেছে যা এবারের আন্দোলনের মাধ্যমে সবার কাছে পরিস্কার হয়েছে।
ইন্টারনেট প্রজন্ম মোবাইল আর ল্যাপটপে ডুবে থাকলেও তারা তারুন্যের জোয়ারে এখনো জেগে উঠতে পারে তারও প্রমান হয়েছে এই আন্দোলনে। তারা সরাসরি দেশের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের উদ্যেগ নিয়েছে। তারা শোষকদের বন্দুকের হুমকিকে অবজ্ঞা করার দু:সাহস দেখিয়েছে। বাংলাদেশে এখনও সেই মা আছে, যারা সন্তানদেরকে তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে ঠেলে দেয়, এখনও মা ছেলের মুখে ভাত খাইয়ে দেশের জন্য উৎস্বর্গ করার সাহস ও মানসিকতা রাখেন, তাও দেখা গেছে এবারের আন্দোলনে।
এবারের আন্দোলনে বোঝা গেছে যে রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগনের মনের ভাষা বুঝতে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে না পারে তাহলে সাধারন মানুষেরাই তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামতে দ্বিধা করে না।
এবারের আন্দোলন প্রমান করেছে, বিগত ১০ বছরের অপশাসনে সরকার মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তারা যতই উন্নয়নের বুলি মুখে আওড়াকনা কেন, মানুষ আসলে এই সরকারের উপর ক্ষেপে আছে এবং প্রতিটি সেক্টরেই তীব্র অসন্তোষ জমে আছে যা ক্ষনে ক্ষনে বিস্ফোরিত হচ্ছে।
যারা ৭২-৭৫ আমলের আওয়ামী দু:শাসন দেখেনি, তারা এতদিন ঘোরের মধ্যে ছিল। মিডিয়ায় বড় বড় কথা বলে সেই সময়গুলো সম্পর্কে একটি মিথ তৈরীর অপচেষ্টা চলেছে গত ৯ বছর ধরে। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে সরকারের প্রতারনা এবং চলমান ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী নিপীড়ণ নতুন প্রজন্মকে সেই দু:শাসন সম্পর্কে ভাল একটা ধারণা দিয়েছে।
ছাত্রলীগের তান্ডব নিয়ে এতদিন বিরোধী দলগুলো সরব ছিল, তবে এবারের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ছাত্রলীগকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে সবাই চিনে ফেলেছে। আমার মনে হয়, এই প্রজন্ম তো বটেই আগামী কয়েক প্রজন্ম আর কোনদিন ছাত্রলীগকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে পারবে না।
শেখ হাসিনাকে স্টেটম্যান হিসেবে দাবী করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তার প্রবঞ্চনা ও প্রতারনা এখন ছাত্রসমাজের কাছে পরিস্কার। এবারের আন্দোলন শুরু করার পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের ৯ দফা দাবী মেনে নেয়ার ঘোষনা দিলেও ছাত্রসমাজ রাজপথ ছাড়েনি। কেননা তারা জানে প্রধানমন্ত্রী প্রতারণা করতে বড্ড পটু। এর আগে কোটা আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে নিয়ে মিছে আশ্বাস দিয়ে পরে তাদের রিমান্ডে নিয়ে পেটানোর উদাহরন আছে এই সরকারের। ছোট ছোট বাচ্চাদের এই রাজনৈতিক পরিপক্কতা থেকে বড়দেরও শেখার আছে অনেক।
এবারের আন্দোলনে এই ছেলে মেয়েগুলো পুলিশকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে, বড় বড় সুশীল ব্যক্তিদেরকে ছেড়ে কথা বলেনি। পুলিশ দিয়ে এদেরকে থামানো যায়নি। বিচারের ভয় পেয়ে তারা পিছু হটেনি। তাদের প্রজন্মের কাছে যেই মানুষগুলোকে হিরো বানিয়ে রাখা হয়েছে, তাদেরকেও তারা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে যখন তারা দেখেছে যে এই তথাকথিত হিরোগুলো সরকারের দালালিতেই সিদ্ধহস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার, ইউটিউবার কিংবা খেলোয়াড় সবাইকেই তারা মাটিতে নামিয়েছে। কেননা এই প্রজন্মের আন্দোলনে তারা তাদের এই সো-কলড আইকনগুলোকে পাশে পায়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা, এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। আমি মনেকরি, এই আন্দোলণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছে। এরা আন্দোলণ করেই যাবে। হয়তো প্রকাশ্যে, বা আড়ালে। কিন্তু এই সরকারের বিরুদ্ধে তারা যে অবস্থান নিয়েছে, সরকারের অপশাসনের জন্য তাদের ভেতরে যে ক্ষোভ জন্মেছে, এটা নি:শেষ হওয়ার নয়।
সেক্টরে সেক্টরে মানুষের মধ্যে যে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে, ছাত্ররা প্রতিবাদের নতুন যে ভাষা শিখিয়েছে তা কোন চোখ রাঙ্গানিতে স্তব্ধ হওয়ার নয়। তাই আন্দোলন থেমে গিয়েছে বলে সরকার যতটাই স্বস্তি অনুভব করুক না কেন, বাস্তবে সরকারের জন্য আগামী দিনগুলো মোটেই স্বস্তির হবে না। এ কথা আকাশে বাতাসে এখনই ভেসে বেড়াচ্ছে।
অ্যানালাইসিস বিডি