সোহরাব হাসান
সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে এর অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নতুন ধারায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, ইতিমধ্যে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে। সম্মেলনের পর কমিটি গঠিত না হলেও কোনো সমস্যা হয়নি। ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া এখন শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়ে আদালত অঙ্গনে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ছাত্রলীগের মারমুখী অবস্থান দেখে শিক্ষাঙ্গনে এ কথাই বেশি প্রচার পাচ্ছে যে সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মেধার জোর কম বলেই তারা কোটাকে চাকরির একমাত্র অবলম্বন হিসেবে নিয়েছেন। আবার এও সত্য যে ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অনেকে ছাত্রলীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সংগঠনটির বিলুপ্ত কমিটির নেতারা পেশিশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে ফের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত রোববার সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, গত শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণসংবর্ধনা শেষে ছাত্রলীগের নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাম জানাতে গেলে তিনি তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রলীগ বাড়াবাড়ি করেছে বলে তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে। আর যেন কোনো অভিযোগ না আসে, সে বিষয়েও তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের নাকি সতর্কও করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী কথাটি বলেছিলেন ছাত্রলীগের নেতাদের যখন তাঁরা তাঁকে সালাম দিতে এসেছিলেন। আর ওবায়দুল কাদের সাহেব সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাটি দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন। এ জন্য তাঁকে কিঞ্চিৎ ধন্যবাদ দিতে হয়। বিলম্বে হলেও ক্ষমতাসীন মহল স্বীকার করে নিল যে ছাত্রলীগ বাড়াবাড়ি করছে। সংসদ বাংলা অভিধান অনুযায়ী বাড়াবাড়ি শব্দের অর্থ হলো আতিশয্য, আধিক্য, কোনো কাজ বা আচরণে সীমা লঙ্ঘন। তিনি পুরো ধন্যবাদ পেতে পারতেন যদি প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের বাড়াবাড়ি ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নিতেন।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা না যেতেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ফের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রোববার বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশ করে যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ধাওয়া দিয়ে একজনকে মারধর করেন। প্রথম আলোর ছবিতে দেখা যায়, ছাত্রলীগের কর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজনের ওপর চড়াও হয়েছেন এবং একজন সাংবাদিক সেই ছবি তুলতে গেলে ছাত্রলীগের বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দিদার মোহাম্মদ নিজামুল ইসলাম মারমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তাঁকে হুমকি দেন। পরে অন্য সাংবাদিকেরা সেখানে চলে এলে তিনি বলেন, ‘দৌড়াদৌড়ি দেখতে গিয়েছিলাম।’ ছাত্রলীগ নেতাদের এই ‘দৌড়াদৌড়ি’ দেখার জেরে রোববার এলিফ্যান্ট রোডে বাটা সিগন্যালে দুজন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন পিটুনির শিকার হন। তাঁরাও কোটা সংস্কারের সমাবেশ থেকে ঘরে ফিরছিলেন।
একই দিন কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আদালত প্রাঙ্গণে অধুনালুপ্ত আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা চালিয়ে তাঁকে আহত ও রক্তাক্ত করেন। গত বছর ১০ ডিসেম্বর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাতের দায়ের করা মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিলেন তিনি। সকাল থেকে ছাত্রলীগের নেতারা আদালত চত্বরে অবস্থান নেওয়ায় মাহমুদুর রহমান বাইরে যাওয়া নিরাপদ বোধ করেননি এবং জামিন পাওয়ার পরও তিনি আদালতের এজলাসে অপেক্ষা করেন। সাড়ে চার ঘণ্টা পর আদালতের পরিদর্শক ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁকে একটি গাড়িতে তুলে দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে অবস্থানরত যুবকেরা লাঠি ও পাথর দিয়ে দফায় দফায় মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা করলে তাঁর মাথা, কপাল ও গাল কেটে যায়।
মাহমুদুর রহমান যে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদাত্মক রাজনীতি করেন, আমরা সব সময়ই তার বিরোধিতা করি। শুধু রাজনীতি নয়, জীবনদর্শনেও তাঁর সঙ্গে আমাদের মিল নেই। ২০১৩ সালে তিনি তাঁর সম্পাদিত আমার দেশ পত্রিকা গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকলে আমরা লিখে তার প্রতিবাদ জানিয়েছি। নিন্দা করেছি। কিন্তু একজন ব্যক্তি যত অন্যায়ই করুন না কেন, আদালত অঙ্গনে তাঁর ওপর হামলে পড়তে হবে কেন? এর মাধ্যমে আক্রমণকারীরা যেমন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, তেমনি আদালতকেও অপমান করেছেন। এখানে পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মামলার বাদী ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি দাবি করেছেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা করেননি। তাহলে কারা হামলা করল? শোনো যায়, কুষ্টিয়ার একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা নাকি মাহমুদুর রহমানকে ‘হালকা নাশতা’ করানোর কথা বলেছিলেন। সেই হালকা নাশতা ‘ভারী’ হয়ে যাওয়ায় এখন আওয়ামী লীগ বিব্রত। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও বলতে হলো, ‘আমি মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা সমর্থন করি না।’
এর আগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপর্যুপরি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, এসব ঘটনা ছাত্রলীগ ঘটিয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখার পর বলা যাবে। ছাত্রলীগের নেতারা যখন আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে তাঁদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য আলোকচিত্রীদের অনুরোধ জানান, তখন ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য সত্য অস্বীকারের ব্যর্থ প্রয়াস বলে মনে হয়। বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে তিনি আরেকবার বলেছিলেন, সম্মেলনের পর ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। নতুন কমিটি ছাড়াই যদি ছাত্রলীগ সারা দেশে এমন ‘সাংগঠনিক কার্যক্রম’ চালাতে পারে, তাহলে কমিটি গঠন করার পর তারা কী করবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
আমরা ছাত্রলীগকে দুই রূপে দেখেছি। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। মার খান। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী জেল-জুলুমের শিকার এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। এখন ক্ষমতায় এসে তাঁরা শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা কোটা আন্দোলনকারীদের নিশানা করছেন না; তাঁদের হাতে অনেক নিরীহ মানুষও নিগৃহীত হচ্ছেন। চট্টগ্রামে এক কোচিং সেন্টারের মালিকের সেই মার খাওয়ার চিত্র অনেকেরই মনে আছে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু সরকারের পুলিশ বাহিনীর ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভরসা রাখতে পারছেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে দলীয় কোন্দলে ছাত্রলীগের কতজন নেতা-কর্মী মারা গেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যদি তার হিসাব নিতেন, তাহলে তিনি তাদের অধঃপতনটি উপলব্ধি করতেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগদানকারী এক নারী শিক্ষার্থীকে যেভাবে মেরে রক্তাক্ত করেছেন, তাতে আওয়ামী লীগের পুরুষ নেতাদের কী ভাবান্তর হয়েছে জানি না, নারী নেত্রীরা নিশ্চয়ই লজ্জিত হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতারা হাতুড়ির ঘায়ে একজন শিক্ষার্থীর পা ভেঙে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁকে চিকিৎসা শেষ না করেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ত্যাগে বাধ্য করেছেন।
কিন্তু এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানা নেই। বরং ছাত্রলীগের হাতে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে পুলিশ বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক ও বাসাবাড়ি থেকে থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। রিমান্ডের নামে কারও কারও ওপর চালানো হচ্ছে শারীরিক নির্যাতন। এ কারণে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাশেদ খানের সঙ্গে ডিবি অফিসে তাঁর মা দেখা করতে গেলে তিনি একটি অনুরোধই জানান, ‘তাঁকে যেন ওরা আর না মারে।’
ওবায়দুল কাদের একজন পেশাদার রাজনীতিক। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আসার আগে তিনি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন। সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছেন। ডাকসু নির্বাচন করেছেন। আশির দশকের প্রথমার্ধে ছাত্রলীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী যখন নবগঠিত জাতীয় ছাত্রলীগে চলে যান, সংখ্যালঘিষ্ঠদের নিয়েই আওয়ামী ধারার ছাত্রলীগ টিকিয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন।
কিন্তু ছাত্রলীগের বর্তমান অধঃপতন ও বাড়াবাড়িতে কাদের সাহেবরা আদৌ বিচলিত বলে মনে হয় না। তাঁরা দিন-রাত বিএনপিকে নসিহত করতে যে সময় ও শক্তি খরচ করছেন, তার সিকিভাগ ছাত্রলীগের পেছনে ব্যয় করলে দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত।
সূত্র: প্রথম আলো