আলী ইমাম মজুমদার
আগামী মাসের ১৫ তারিখে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা। এর বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে। অংশগ্রহণ করছেন প্রধান দুটি দল ছাড়াও অনেক দলের প্রার্থীরা। এ দুটি নির্বাচনে সেনা নিয়োগের দাবি জানিয়েছে অংশগ্রহণকারী প্রধান একটি দল। নির্বাচন কমিশন এমনটা করতে অসম্মতি জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমিশনের অবস্থান সমর্থনযোগ্য। দুটি সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা, আয়তন ইত্যাদি বিবেচনায় এখানে নিরাপত্তা বিধানের সামর্থ্য বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রয়েছে। সর্বমোট ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দুটি সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা ৬০ লাখ। গোটা দেশের বিবেচনায় অতি সীমিত পরিসরের নির্বাচন বিধায় গণমাধ্যমের উপস্থিতিও থাকবে নিবিড়। সবকিছু মিলিয়ে কোনো অঘটন না ঘটলে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন তাঁদের পছন্দের প্রার্থীদের।
আর সেই অঘটন ঘটানোর সুযোগ যেন কোনো পক্ষ না পায়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে কমিশনকে। ধারণা করা যায়, তারা দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকবে। আর এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সেনা তলব করা হয়নি। তবে জাতীয় নির্বাচনে সেনা নিয়োগ নিয়ে এর মধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের জাতীয় নির্বাচনে সামরিক বাহিনী বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় নিয়োজিত থাকে। তবে এই নিয়োগের আকৃতি ও প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন দাবি ও পাল্টা মতামত আমরা শুনতে পারছি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। তাঁর এই বক্তব্যের জের ধরে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, কমিশন সামরিক বাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। মন্তব্যটি বেসুরো মনে হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন চাইলে সরকারকে ভিন্নমত দেওয়ার কোনো সুযোগ সংবিধানে রাখা হয়নি। অবশ্য আমাদের দেশে ২০০৩-২০০৪ সালে জোট সরকারের সময় তেজগাঁও নির্বাচনী এলাকায় সংসদ উপনির্বাচনে এবং ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশনের অনুরূপ উপেক্ষার নজির রয়েছে।
প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন জোট চায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় হোক। অন্যদিকে সরকার সংবিধানের বর্ণিত ব্যবস্থায় নির্বাচন প্রসঙ্গে অনড় অবস্থানে আছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কোনো অবস্থান নেওয়ার সুযোগ খুবই ক্ষীণ। তবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অভিন্ন সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। ২০১৪ সালের মতোই সংসদ বহাল থাকবে। এ ক্ষেত্রে কয়েক দিন আগে সিইসি বলেছিলেন, আচরণবিধিতে কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হতে পারে। এরপর সব চুপচাপ। অন্যদিকে আলোচ্য দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে তাদের আচরণবিধিতে একটি রাজনৈতিক দলের সুপারিশে সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান বলে জানা যায়। এতে সংসদ সদস্যদের তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালানোর সুযোগ রাখা হচ্ছে। কোনো খেলা শুরু হওয়ার পর এর নিয়মকানুন সংশোধন অনৈতিক বলে গণ্য করা হয়। তেমনি এ ধরনের সুবিধাদান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতসুলভ আচরণ বলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কমিশন বলছে, এসব স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে তারা জাতীয় নির্বাচনের জন্য শিক্ষা নেবে। এখন সরকারি দলের চাপের মুখে নির্বাচনের আগে যদি নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি সংশোধন করে তাহলে তা একটি মন্দ দৃষ্টান্ত হিসেবেই বিবেচিত হবে।
জাতীয় নির্বাচন সারা দেশে এক দিনে হবে। সাড়ে ১০ কোটি ভোটার। প্রায় ৫০ হাজার ভোটকেন্দ্র। সেই কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশের যোগাযোগব্যবস্থা সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রের মতো হবে না। বিরাটসংখ্যক ভোটকেন্দ্র থাকবে দূরদূরান্তে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্গম। এতগুলো ভোটকেন্দ্রে এক দিনে ভোট গ্রহণের জন্য যে জোরদার নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা দরকার, তা বেসামরিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য একরূপ অসাধ্য হবে। আর জাতীয় নির্বাচনে সরকার বদল হয় বলে ক্ষমতা ধরে রাখতে কিংবা তা ছিনিয়ে নিতে বেপরোয়া হতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো। এর চাপ পড়বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর।
কেন্দ্রের প্রহরায় পুলিশ আর আনসারই থাকে। আর সেই প্রহরাব্যবস্থা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তুলনায় একেবারেই ভঙ্গুর। র্যাব, বিজিবি আর সামরিক বাহিনী থাকে মোবাইল, স্ট্রাইকিং কিংবা রিজার্ভ হিসেবে। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন। অপরিসীম লিখিত ও অলিখিত ক্ষমতার অধিকারী সাংসদের প্রভাববলয়ে বেসামরিক প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাবু হয়ে পড়তে পারে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও সেখানে থাকবেন অসহায় অবস্থায়। সেই অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে সামরিক বাহিনী কার্যকর সংখ্যায় মোতায়েন কিছুটা ইতিবাচক ফল দিতে পারে। সে জন্য নির্বাচন কমিশনের আগাম একটি নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা উচিত।
জাতীয় নির্বাচন খুব দূরে নয়। সেই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এটা শুধু অংশগ্রহণমূলক হলেই হবে না। ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার-প্রচারণায় সমান সুযোগের কথা বলা হচ্ছে বারবার। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনটি সফল করতে হলে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর কমিশনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখন থেকে হিসাব-নিকাশ করে ঠিক করতে হবে। নির্বাচনের ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করে এসব কাজে হাত দিলে ফল পাওয়া যাবে না। তফসিল আগে ঘোষণা করার তেমন কোনো আইনগত বিপত্তি আছে বলে জানা যায় না। থাকলেও তা অপসারণের ব্যবস্থা করা দরকার। এ রকম করতে পারলে কমিশন জনপ্রশাসন ও পুলিশে কিছু আবশ্যকীয় রদবদল করতে পারবে। এমনটা করা হলে নির্বাচন পরিচালনাব্যবস্থায় কমিশনের কর্তৃত্ব দৃশ্যমান হবে।
এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাব্যবস্থার মূল দায়িত্বে বরাবরের মতো পুলিশই থাকবে। তবে অধিক পরিমাণে সামরিক বাহিনীর মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করলে ভোটদান প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট ইতিবাচক ফল দেবে। আর এমনটা করতে হলে কমিশনের এখন থেকেই সরকারের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের আবশ্যকতা রয়েছে। তার আগে তাদের বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে বৈঠক করে এর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনাব্যবস্থার মূল দায়িত্বে যেহেতু কমিশন, তাই তাদের অগ্রণী ভূমিকা থাকা আবশ্যক।
সেনা নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এত কথা বলার কারণ, তাদের কনিষ্ঠ ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সৈনিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের মাখামাখির কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর অবস্থান তার বিপরীতে। নির্বাচনটা যেহেতু হতে যাচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে এবং সংসদ বহাল রেখে, সে ক্ষেত্রে সেনা মোতায়েনের সংখ্যাও অনেক বাড়াতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের নির্বাচনে বরাবর নৌবাহিনী কার্যকর ভূমিকা নেয়। তবে এবার তাদের সংখ্যাও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তেমনি অন্য সব উপজেলায় (জনসংখ্যার আকৃতি বিবেচনায়) ৫ থেকে ১০টি সেনা মোবাইল টিম করার মতো সেনা মোতায়েন কার্যকর সুফল দেবে। আর তা সময়মতো পেতে হলে পূর্বপরিকল্পনা দরকার। দরকার বাজেটের।
সুতরাং নির্বাচন কমিশনের জন্য সংগত হবে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে সংলাপ শুরু করা। নির্বাচন সবাই চায়, তবে নিজের মনগড়াভাবে চাইলে হবে না। আর কমিশনও দেখা যাক বলে সময়ক্ষেপণ করলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের সাফল্যের ক্ষেত্রে। তাদের সামনে দুটিই রাস্তা। একটি সাফল্যের। তার জন্য আন্তরিকতার পাশাপাশি প্রয়োজন দৃঢ়তা ও যথাযথ সিদ্ধান্ত। অন্যটি অবশ্যই ব্যর্থতার। এর জন্য তেমন কিছু করতে হবে না। আপনা থেকেই হবে। আর তা হলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে একটি জাতি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
সূত্র: প্রথম আলো