নিজ নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধির জন্য ছাত্রলীগের দুই নেতা মৌলভীবাজার সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। ছোট ছোট মারামারি ও হাতাহাতি হচ্ছিল প্রায়ই। শেষ পর্যন্ত মীমাংসার কথা বলে ডেকে এনে এক পক্ষের দুজনকে কুপিয়ে ও রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে অন্য পক্ষ। নিহত দুজনের একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অন্যজন কলেজছাত্র। হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যেও রয়েছে স্কুলছাত্ররা।
গত ৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার শহরেই ঘটে এই জোড়া খুন। প্রায় দুই মাসেও এ মামলার এক নম্বর আসামি ছাত্রলীগ নেতা আনিসুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে তুষারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এজাহারভুক্ত ১২ আসামির পাঁচজন কারাগারে, অন্যরা কোথায়, পুলিশ তা বলতে পারছে না।
মৌলভীবাজারের মতো ছোট্ট শান্ত শহরে যেখানে প্রায় সবাই সবার আত্মীয়, সেখানে কিশোর-তরুণদের এই নৃশংসতায় মানুষ স্তম্ভিত। খুনের ঘটনাটি
ঘটে মৌলভীবাজার সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় পোস্টার। সেখানে নিহত ছাত্রলীগ নেতা মো. শাবাব আলী ও এসএসসি পরীক্ষার্থী নাহিদ আহমেদের ছবির নিচে আনিসুল ইসলাম চৌধুরী ছাড়াও খুনের আসামি কিশোরদের ছবি দেখা যায়। রাজনীতির নামে মাস্তানিতে জড়িয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কা থেকে অনেক মা–বাবা এখন আর তাঁদের সন্তানদের বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না।
নিহত শাবাব আলীর মা সেলিনা রহমান চৌধুরী মৌলভীবাজার মডেল থানায় হত্যা মামলা করেছেন। তবে ন্যায়বিচার পাবেন না, এই আশঙ্কায় ১৫ বছর বয়সী নাহিদ আহমেদের পরিবার থানায় যায়নি। নাহিদের বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। আর্থিক অনটনের কারণে নাহিদ যখন ছোট্ট তখনই নানাবাড়িতে চলে এসেছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারটির ছেলে স্কুলে পড়ছে, সে ভালো ফল নিয়ে পাস করে বের হবে—এমনই স্বপ্ন ছিল স্বজনদের। সব স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেছে।
নাহিদের পরিবারের ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা, শাবাবের স্বজনদের মনে সংশয়। তাঁদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হবে না। জোড়া খুনের মামলার তদন্তে জড়িত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল আসামি আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। সে খুব চতুর। শক্তিধরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে।’ মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল আহমেদ বলেন, আসামি ধরা পড়বেই।
এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, জোড়া খুনের মামলার আসামি আনিসুল ইসলাম চৌধুরী এবং নিহত ছাত্রলীগ নেতা শাবাব দুজনেই পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ছাত্রলীগের কমিটিতে তাদের কোনো পদ না থাকলেও নিজ নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধির জন্য স্কুলছাত্রদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছিল।
শাবাবের মামা হাবিব রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনিসুল ও শাবাব দুজনকেই মেয়র সাহেবের ডান হাত-বাম হাত বলা হতো। তবে এখন মেয়র সাহেবের ভূমিকা অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো। মৃত ব্যক্তি তাঁর আর কোনো কাজে আসবে না। সে জন্য তিনি হয়তো এড়িয়ে চলছেন।’ তিনি আরও জানান, হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে তাঁরা যে মানববন্ধন করেছেন, সেখানেও মেয়রকে ডেকে আনতে হয়েছে।
তবে আসামিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পৌর মেয়র ফজলুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তুষার ও শাবাবের মতো হাজার হাজার অনুসারী তাঁর আছে। তাঁর সঙ্গে ওই দুজনের তেমন ঘনিষ্ঠতাও ছিল না। এমনি চিনতেন। মেয়রের দাবি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি এতটাই ব্যস্ত যে অন্য কোনো দিকে নজর দেওয়ার সময়ই পাচ্ছেন না।
যা ঘটেছিল
শাবাব আলীর মা সেলিনা রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে ও আনিসুল একসঙ্গেই চলাফেরা করত। শাবাব সিলেটের মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিল। ছেলেকে চোখের আড়াল করতে চান না বলে মৌলভীবাজারে ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন মা। দ্রুতই তাঁদের অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। সেলিনা বলেন, ‘আমি শাবাবকে জিজ্ঞেস করেছি, কিসের আশায় রাজনীতি করছ? শাবাব বলেছিল, ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তাকে বড় পদ দেওয়া হবে।’
জানা যায়, আনিসুলও ভালো পদ পাওয়ার আশা করছিলেন। মৌলভীবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের মতো কলেজেও তাঁর প্রভাব আছে। তাঁর মা হাসনা খানম বলেন, ছেলে মেয়রের দল করে। ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ছেলেকে ভালো পদ দেওয়ার কথা। কেউ হয়তো এ কারণেই হিংসা করে হত্যা মামলায় ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
কে কার চেয়ে এগিয়ে আছে—এ নিয়ে শাবাব ও আনিসুলের মধ্যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে স্কুলের এক ছাত্রের (হত্যা মামলার আসামি, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় নাম প্রকাশ করা হলো না) সঙ্গে নিহত নাহিদের মারামারি হয়। নাহিদ পিটিয়ে ওই ছেলের হাত ভেঙে দিয়েছিল। শাবাব নাহিদের পক্ষে আর আনিসুল ওই ছেলেটির পক্ষে ছিল। ৭ ডিসেম্বর শাবাব পুরাতন হাসপাতাল রোডে বাসার সামনে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ তার কাছে একটি ফোন আসে। সে তখনই মৌলভীবাজার উচ্চবিদ্যালয় মাঠে যায়। তখন আরও কয়েকজন স্কুলছাত্র ঘটনাস্থলের দিকে যায়।
শাবাবের মামা হাবিব রহমান বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন আগে থেকেই ওই মাঠে কয়েকজন ছাত্র অপেক্ষা করছিল। পরে আনিসুল আরও দুজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সে সাদা রঙের একটি গাড়ি থেকে ধারালো অস্ত্র ও রড বের করে। শাবাব ও নাহিদ পৌঁছালে তাদের রড দিয়ে পিটিয়ে ও উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে আনিসুল ও তার দল।
মৌলভীবাজারের প্রবাসী সাংবাদিক মুনজের আহমেদ চৌধুরী একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁদের শহরের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ভালো। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে কখনোই বড় ধরনের বিবাদ দেখা যায়নি। পরিস্থিতি যে ভেতরে ভেতরে অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে, তার প্রমাণ এই জোড়া খুন।
মৌলভীবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা দেখছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেরা কথাবার্তা শুনলেও নবম শ্রেণি থেকে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। স্কুলের ভেতরে খুব বিশৃঙ্খলা না করলেও বাইরে থেকে প্রায়ই অভিযোগ আসছে।
সূত্র: প্রথম আলো