অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ী আরো একটি বছর বিদায় নিলো আমাদের মধ্য থেকে। কালের অতল গহবরে হারিয়ে যাবে ২০১৭ সাল। অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিয়ে একটি বছর হারিয়ে গেলেও সেই ঘটনাগুলোর রেশ থেকে যায় বহুদিন বহুকাল ধরে। ২০১৭ সাল অসংখ্য পরিবারের নিকট এক আতঙ্ক ও বেদনার বছর হিসেবে স্থান করে নিবে। কারণ এই বছরে অসংখ্য মানুষ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। এই হারানো মানে স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে হারানো নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে গুম অপহরণের শিকার হয়ে অনাকাঙ্খিতভাবে হারিয়ে গেছেন তারা। সারা বছরজুড়েই আলোচিত ও আতঙ্কিত একটি ইস্যু ছিলো গুম-খুন ও অপহরণ।
আলোচিত ঘটনাগুলোর দিক থেকে এর পরই অবস্থান প্রশ্ন ফাঁসের। পরীক্ষা মানেই যেনো এখন প্রশ্ন ফাঁস। নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষামন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের রামরাজত্ব চলে আসছে। তিনি যেনো সবার হাতে প্রশ্ন পৌঁছে দেয়ার শপথ নিয়েই মন্ত্রীত্ব গ্রহন করেছিলেন। প্রশ্ন ফাঁসের ক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোর ন্যয় ২০১৭ সালও ব্যতিক্রম ছিলো না। বরং বিগত বছরগুলোর চেয়ে এগিয়েই থাকবে বিদয়ী বছরটি। বিশেষ করে প্রাথমিকের অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান-টু এর পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে এই বছর। এজন্যও বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০১৭ সাল।
গুম, খুন, অপহরণ ও আতঙ্কের বছর
২০১৭ সালের প্রতিটি মাসেই একাধিক গুমের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক, কূটনীতিক, ব্যাংকার বা অন্য পেশার মানুষও নিখোঁজ হয়েছে এই সময়। পুলিশ গ্রেফতারের পর গুম রয়েছেন এমন সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫ জন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন দীর্ঘদিন নিখোঁজের পর ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে ১৬ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। লাশ পাওয়া গেছে ৭ জনের। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৩৩ জন। (যুগান্তর)
যাদের গুম হওয়া সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন- কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান সিজার, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, সাংবাদিক উৎপল দাস, কানাডা প্রবাসী শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, বিজেপির নতুন নেতা মিঠুন চৌধুরী ও আশিক ঘোষ, আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদ প্রমুখ।
এপ্রিল মাসে সুইডিশ রেডিওতে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব এর গুম খুন বিষয়ক একটি রোমহর্ষক অডিও ফাঁস হয়। এনিয়ে তখন দেশজুড়ে ব্যপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সর্বত্র বিশেষ করে বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফাঁস হওয়া ঐ অডিওতে স্পর্শকাতর এক গোপন আলাপচারিতায় র্যাবের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তাদের সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে শোনা যায়। র্যাবের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, “তোমরা যদি তাকে(টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে) খুঁজে পাও, শুট এন্ড কিল হিম(গুলি করো এবং হত্যা করো), সে যেখানেই থাকুক। এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও।” বিচারবহির্ভুত হত্যার এমন রোমহর্ষক নির্দেশ দেয়ার পর পুলিশের এলিট ফোর্স কিভাবে কাকে হত্যা করবে এসব তালিকা কিভাবে নির্বাচন করে এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এমনকি এই কর্মকর্তা যে নিজেই অসংখ্য হত্যার সাথে জড়িত তা নিজেই উল্লেখ করেন।
অপহরণ ও গুমে জড়িতদের কোনো তথ্য প্রমান বিগত সময়ে পাওয়া না গেলেও এ বছর তার একটি প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু সেটিকে কাজে লাগিয়ে অপহরণকারীদের ধরার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি পুলিশ। ২৩ আগস্ট রাজধানীর পল্টনের খানা বাসমতি রেষ্টুরেন্টের সামনে থেকে আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় অপহরণকারীদের চেহারা সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়ে। কিন্তু কোনো এক গোপন কারণে সেই অপরাধীদের ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি পুলিশ। এই অপহরণকারীরাও অপহরণের সময় নিজেদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বলে এবং আইডি কার্ড দেখিয়ে পরিচয় দিয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই ব্যাংক কর্মকর্তাকে দ্রুত ছেড়ে দিলে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
সারা বছরজুড়ে গুম খুনের আতঙ্কে কাটলেও বছরের শেষদিকে এসে কয়েকজন ফিরে আসায় আশা জাগে গুম হওয়া পরিবারগুলোতে। প্রায় চারমাস গুম থাকার পর ২০১৭ সালের শেষ দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর পুলিশ গ্রেফতার দেখায় বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সাদাত আহমেদকে। গুম থেকে ফিরে আসাদের মধ্যে আরো রয়েছেন ফরহাদ মজহার, মোবাশ্বার হাসান সিজার, অনিরুদ্ধ রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম, সাংবাদিক উৎপল, বিজেপির দুই নেতা প্রমুখ।
আগে থেকে গুম থাকা বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বড় ছেলে ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমী, জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে আহমাদ বিন কাশেম আরমান, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নেতা ওয়ালিউল্লাহ ও আল মোকাদ্দাসের ফেরার আশায় তাদের পরিবারের সদস্যরা পথ চেয়ে থাকলেও তারা কেউই ফিরে আসেনি। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে এসেছেন এ বছরে।
গুম থেকে যারা ফিরছেন তারা কেউই মুখ খুলছেন না। তাদের প্রত্যেককেই খুব অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। সবার মধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করতে দেখা গেছে। এমন তাদের পরিবারের যেই সদস্যরা গুম থাকাবস্থায় সরব থেকেছেন তারাও পরবর্তীতে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন পর্যন্ত গুম খুনে জড়িত একজন ব্যক্তিকেও আটক করতে পারেনি। এসব ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এজন্য কয়েক বছরের ন্যয় এবছরের গুম খুনের ঘটনাগুলোর জন্য অভিযোগের তীর তাদের দিকেই যাচ্ছে।
এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বাসা থেকে তুলে নেয়ার ৭ ঘণ্টা পর কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরুকে (৪৫) মাথায় গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ নদীর পাড়ে ফেলে রাখা হয়। এই নৃশংস ঘটনাটিও এই বছরের একটি নির্মম ও আলোচিত ঘটনা।
পরীক্ষা মানেই প্রশ্ন ফাঁস
‘পরীক্ষা মানেই প্রশ্ন ফাঁস’ এবছর সবার মনে এমন একটি বিশ্বাসের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ বছরের এমন একটি পরীক্ষাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি-জেডিসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মুড়ি মুড়কির মতো মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র। অবাক করা বিষয় হচ্ছে ক্লাস ওয়ান-টু এর মত পরীক্ষাগুলোতেও এখন প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। যার সম্পূর্ণ অবদান শিক্ষামন্ত্রী নাহিদের। এবং এমন অবদানের জন্যও স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২০১৭ সাল।
বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত হলেও বাতিল করা হয়নি পরীক্ষা। ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সাথে মূল প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেলেও অনেক সময় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কখনো কখনো সাজেশন বলেও বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে অধিকাংশ সময়ই ছাত্রলীগ ও সরকারি দলের নেতাকর্মীদেরকে জড়িত দেখা গেছে। কিছুক্ষেত্রে গ্রেফতার করা হলেও তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে দেখা যায় নি।
অল্পকিছু ছাড়া অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে প্রশ্নপত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আগের রাত্রে ফেসবুকে পাওয়া হুবহু প্রশ্নেই পরীক্ষা হয়েছে পরের দিন। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর আন্দোলনে নেমেছেন ভর্তিচ্ছুকরা। ‘প্রশ্ন যদি হবে ফাঁস পড়ব কেন বার মাস’ এমন স্লোগান ধারণ করে তারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেও কোনো লাভ হয়নি।
বছরের পুরোটা সময় প্রশ্নফাঁসের কতা অস্বীকার করলেও বছরের শেষে এসে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ স্বীকার করেছেন যে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। স্বীকারোক্তি দিয়ে তিনি বলেছেন, ১৯৬১ সাল থেকেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে আসছে। আগে দুইমাস আগে প্রশ্ন ফাঁস হতো, এখন হয় পরীক্ষার দিন সকালে। এভাবেই তিনি প্রশ্ন ফাঁসকে একটি সহজ বিষয়ে পরিণত করেছেন।