এম আই খান
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো জাতিগত নিধনযজ্ঞ দেখে শিউরে ওঠেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু তাতে বিশ্ব বিবেকে কতটুকু নাড়া লেগেছে সেটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কোন কোন দেশ ত্রাণ ও মানবিক সহায়তায় হাত বাড়ালেও তার সংখ্যা খুবই নগণ্য। অধিকাংশ রাষ্ট্রই এ বর্বরতা দেখে ‘আহা’ ‘উহু’ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কেউবা আরো একটু এগিয়ে এসে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই যেন দায়িত্ব শেষ। অব্যাহত নিপীড়নের শিকার এই রোহিঙ্গা মুসলমানরা যেন এ পৃথিবীতে জন্মলাভ করেই সবচেয়ে বড় অন্যায়টি করেছে। তাই তাদের অধিকার আদায়ে সহায়তায় এগিয়ে আসার যেন কেউ নেই।
বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই নাকি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তথাকথিত বিশ্ব নেতারা যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য লিগ অব নেশন্স গঠন করেছিলেন। সংঘর্ষ ও উত্তেজনা রোধে সংস্থাটি কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিল বলেই তা ইতিহাস থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সকল ভয়াবহতাকে হার মানিয়ে যায়। তথাকথিত বিশ্বনেতারা এখানেও সুযোগ গ্রহণের জন্য ওৎ পেতে থাকে। মূলত এরা ছিল বিশ্ব নেতার চেহারা ধারণ করা একদল সাম্রাজ্যবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিজয়ী মিত্রশক্তি পরবর্তীকালে যুদ্ধ ও সংঘাত প্রতিরোধ করার উসিলা দেখিয়ে এই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়।বলা যায় লিগ অব নেশন্স-এর ধ্বংস্তুপের ওপর দাঁড়িয়েই ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। চলুন দেখে নেয়া যাক কি কি উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়- ১) বিশ্বব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, ২) পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন এবং ৩) মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাবলী নিরসনের দ্বারা সৃষ্ট বাধ্যবাধকতার প্রতি সুবিচার ও সম্মান প্রদর্শন করা এবং জাতিসংঘকে রাষ্ট্রসমূহের ক্রিয়া-কলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।
প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ কি তার এই উদ্দেশ্য তিনটির আশেপাশেও দাঁড়িয়ে আছে? নাকি প্রতিনিয়ত সরে যাচ্ছে যোজন যোজন দূরত্বে? বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের একদম কোনই অর্জন নেই তা বলা ভুল। কিন্তু প্রত্যাশিত অর্জনের যে ধারে কাছেও যেতে পারেনি তা বলার জন্য খুব বড় আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ আপনাকে হতে হবে না। ৭০ বছরের ইতিহাসে জাতিসংঘের সফলতার পরিসংখ্যান হাতেগোনা। কিন্তু যে শান্তি ও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে এর প্রতিষ্ঠা, তা দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে স্বয়ং জাতিসংঘেরই গঠিত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো। জাতিসংঘের সাংগঠনিক কাঠামো মোট ৬টি সংস্থায় বিভক্ত। এর সবচেয়ে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ সংস্থা হলো The Security Council তথা নিরাপত্তা পরিষদ। এর আবার সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত অংশ হলো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যগুলো। যারা নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী পাঁচ পরাশক্তি – চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে এরাই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে এরা খোদ জাতিসংঘকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। অন্যায়ভাবে ধ্বংস করেছে অনেক জনপদ। যার বলি হয়েছে অনেকগুলো মুসলিম জাতি ও রাষ্ট্র। বলা হয়ে থাকে জাতিসংঘের উদ্যোগে যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে তার অধিকাংশই খ্রীস্টান প্রধান এলাকা। উদাহরণ স্বরূপ পূর্বতীমূর কিংবা দক্ষিণ সুদান এর কথা নিকট অতীত থেকে খুব ভালোভাবেই বলা যাবে। কিন্তু বিপরীত চিত্র যদি বলি তাহলে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর আর আরাকানের মত অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যারা যূগ যূগ ধরে নিজভূমে পরবাসী হয়ে আছে। কসোভো ও বসনিয়া হার্জেগোভিনার যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষতার যুগেও তাদের সাথে ইতিহাসের নৃশংসতম আচরণ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের দিকে তাকালে তাকে নখ দন্তহীন বলেই মনে হয়।
জাতিসংঘ মূলত অনেকটাই বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার, জাতিসংঘ সনদের তোয়াক্কা না করা এবং সাধারণ পরিষদকে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলার মানসিকতার কারণে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন একতরফা হামলায় জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা ও ন্যাটোর মত সামরিক সংগঠন জাতিসংঘের ওপর বিভিন্নভাবে প্রভাব তৈরি করেছে, যা সংগঠনটির স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো যদি নির্বিঘ্নে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়ার অবারিত সুযোগ পেতেই থাকে, তবে কি প্রয়োজন আছে এমন অকার্যকর বিশ্ব সংস্থার?
সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারের আরাকানে মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের চালানো জাতিগত নিধন চালানোর পর জাতিসংঘ বেশ সরব ভূমিকা পালনের অভিনয় করেছে। নিরীহ ভঙ্গিতে নিন্দা জানানো থেকে শুরু করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অসহায় শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতার মাধ্যমে ভূমিকা পালনের চেষ্টা চালিয়েছে। জাতিসংঘের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো যেতেই পারে। কিন্তু, মায়ানমারকে এ বর্বরতা বন্ধ করতে বাধ্য করার কথা যদি বলা হয়, সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের অর্জন নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠির ওপর চালানো এই বর্বরতম ধ্বংসযজ্ঞকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মত যেসব রাষ্ট্র প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে তাদেরকেও নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অভিভাবকের আসনে আসীন হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা জাতিসংঘের নেই। কারণ, পরোক্ষভাবে এই জাতিসংঘই অনেক দেশ থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠিকে বিতাড়িত করে শরণার্থী হতে বাধ্য করেছে। যার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ার মুসলিম জনগণ। বিশ্বের দুই পরাশক্তির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এ সমৃদ্ধ দেশগুলোর জনগণ আজ ভিখারী হওয়ার যোগ্যতাও হারিয়েছে। অথচ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যই নাকি এ জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল!
পরিশেষে বলতে চাই, মূলত আমেরিকা পরিচালিত এই জাতিসংঘ দিয়ে বিশ্বে কতটুকু শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতার বলি হয়ে দেশে দেশে মানবতা ও মানবাধিকারের যে দূর্ভিক্ষ পরিলক্ষিত হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য আশু সমাধানের পথে হাঁটা প্রয়োজন। আর এ জন্য হয় জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে, অন্যথায় মুসলিম প্রধান দেশগুলোর বোধোদয় হতে হবে। মানবতা, মানবাধিকার আর শান্তির কথা বলে অশান্তি সৃষ্টির ক্রীড়নকদের হাতিয়ার হিসেবেই যদি জাতিসংঘ কাজ করে, তবে প্রয়োজন নেই এই সংঘের। আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকেই নতুন করে ভাবতে হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান যথার্থই বলেছেন- ‘The world is bigger than five’. অর্থাৎ- ‘বিশ্ব পাঁচ এর চেয়ে বড়’। পাঁচ পরাশক্তির দাবার গুটি হয়ে বেঘোরে প্রাণ দেয়ার কোন মানে হয় না। লিগ অব নেশনসের মতই নখ-দন্তহীন জাতিসংঘের পরিণতি হোক। অথবা জাতিসংঘ ঘুরে দাঁড়াক মানবতা আর শান্তির রক্ষক হয়ে।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট
Discussion about this post