রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণে চরম বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে অভিযোগ করে বিএনপি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে দেশি বিদেশি ত্রাণ সুষ্ঠু বন্টনের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছে। সে সাথে সরকারকে কাঁদা ছোড়াছুরি বন্ধ করে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
আাজ রোববার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জাতীয় ত্রাণ ও সহায়তা কমিটির প্রধান মির্জা আব্বাস বলেন, রোহিঙ্গাদের মাঝে বিরোধী দলকে ত্রাণ বিতরনে বাধা দিয়ে সরকার প্রমাণ করেছে রোহিঙ্গাদের মাঝে সরকারের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম লোক দেখানো। তারা রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এসময় রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস অভিযোগ করে বলেন, ত্রাণ বিতরণে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা লুটপাট ও ত্রাণ আত্নসাৎ করছে।
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। এসময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত বক্তব্যে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইন প্রদেশে গণহত্যা শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে গত ২৫শে আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। প্রথম দিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশে বাধা দেয় এবং সীমান্ত পার হয়ে আসা নারী ও শিশুদের পর্যন্ত মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
তিনি বলেন, গত ৯ সেপ্টেম্বর দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির ৪জন সদস্য, ৩জন ভাইস চেয়ারম্যান, কয়েকজন সম্পাদক এবং কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং কক্সবাজার জেলার সাবেক সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে বিএনপির জাতীয় ত্রাণ ও সহায়তা কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটির আহবায়ক জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে কমিটির কয়েকজন সদস্য গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার পৌঁছান। ইতোমধ্যে দু:স্থ রোহিঙ্গাদের জন্য চাল, ডাল, চিড়া, চিনি, সোয়াবিন, বিস্কুট, লবণ, মিনারেল ওয়াটার এবং প্লাস্টিক সীটসহ বিপুল পরিমান ত্রানসামগ্রীর ব্যবস্থা করা হয়।
এসব সামগ্রী ১২ সেপ্টেম্বর বিকাল থেকেই বিলি করার সিদ্ধান্ত থাকলেও দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের কারণে তা বন্ধ রাখা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে ছোট-বড় ২২টি ট্রাক ভর্তি ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সফর উপলক্ষে দুপুরের পর ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন থেকে অনুরোধ করায় আমরা ১৩ সেপ্টেম্বর বিকাল ২টার দিকে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে রাখা ট্রাকভর্তি ত্রানসামগ্রী নিয়ে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে দেখতে পাই যে, আমাদের সবচেয়ে সামনে রাখা ট্রাকের মুখোমুখি পুলিশের একটি পিক আপ এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে সেখান থেকে কোনো গাড়ী সামনে অগ্রসর হতে না পারে। ওখানে অনেক পুলিশ সদস্য অবস্থান নেয়। আমরা এও দেখতে পাই যে, সারিবদ্ধ ট্রাকগুলোর পিছনেও পুলিশ অবস্থান নিয়েছে।
মির্জা আব্বাস বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তারা একজন সরকারী কর্মকর্তার ফোন নম্বর দিয়ে অনুমতি নিতে বলেন। তৎক্ষনাৎ ফোনে সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাকে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। আমরা দলের জেলা কার্যালয়ে বসে বার বার ফোন করার পরেও তাকে না পেয়ে ট্রাক বহর নিয়ে রওনা হতে চাইলেও পুলিশ তাদের পিক আপ সরাতে অস্বীকার করে। আমরা জানতে পারি যে, অনেকগুলো ট্রাকের ড্রাইভারের নিকট থেকে ট্রাকের চাবি নিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করলে কিছুক্ষণ পরে চাবি ফিরিয়ে দেয়া হলেও ড্রাইভারগণ আমাদের জানায় যে, গাড়ী চালালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে পুলিশ।
এমতাবস্থায় আমরা দলের জেলা বিএনপি কার্যালয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের ব্রিফ্রিং করে আমাদের গাড়ী নিয়ে হোটেলে ফেরার সময় সড়কের দুই মুখেই পুলিশ বেরিকেড দিয়ে আমাদের আটকে দেয়। আমরা জানতে পারি যে, সড়কের সকল গলিমুখেও বেরিকেড দেয়া হয়েছে। রাস্তায় কেনো বেরিকেড দেয়া হয়েছে-এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি পুলিশ।
তিনি বলেন, আমরা রাতেই স্থানীয় জেলা প্রশাসক এবং তার পরামর্শক্রমে এডিসির সাথে কথা বলি। আমাদের দলের জেলা সভাপতি ও সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী এবং দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও সাবেক এমপি লুৎফর রহমান কাজল একাধিকবার ব্যক্তিগতভাবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে আলোচনা করলেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রশাসন থেকে আমাদের ২০/৩০টি ত্রাণের ব্যাগ প্রতিকী বিতরণের ফটোসেশন করার এবং অবশিষ্ট সব ত্রাণসামগ্রী সরকারী গুদামে জমা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। আমরা তাদেরকে প্রস্তাব দেই যে- হয় আপনারাই এসব সামগ্রী বিতরণ করুন- আমরা সাথে থাকবো; কিম্বা আমরা বিতরণ করি- আপনারা সাথে থাকুন। তারা আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হননি।
উল্লেখ্য যে, ১১ই সেপ্টেম্বরই আমাদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ প্রায় পাঁচ হাজার দু:স্থ রোহিংগা পরিবারের মধ্যে টোকেন বিতরণ করেছিলেন এবং ১ম দিন আমাদের তাদের মধ্যেই ত্রাণ বিতরণের কথা ছিল। সমস্ত আয়োজন এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে কোনো বিশৃংখলা হতো না এবং প্রকৃত নি:স্ব ও ক্ষুধার্ত রোহিংগা শরনার্থী পরিবারগুলোই ত্রান সামগ্রী পেতো। পরবর্তী দিনগুলোতেও ত্রান সামগ্রী বিতরণের প্রস্তুুতি ছিল আমাদের।
সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাস বলেন, ১৩ তারিখেও ত্রাণ বিতরণ করতে বাধা দেওয়ায় আমরা ১৪ই সেপ্টেম্বর টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সফর করে স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা করা কিছু ত্রানসামগ্রী বিতরণ করি। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন এমন কয়েকটি স্থানে আপাতত: ৪০টি সেনিটারী টয়লেট স্থাপনের এবং ১২টি টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা করি। এছাড়াও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও মসজিদের মাধ্যমে মৃত মানুষদের দাফন কিম্বা সৎকারের জন্য আমরা আর্থিক সহায়তা প্রদান করি।
তিনি বলেন, রোহিংগা শরনার্থীদের আশ্রয় স্থলসমূহ পরিদর্শনকালে আমরা অত্যন্ত বেদনার সাথে পরিবার বিচ্ছিন্ন নারী ও শিশু, পিতৃহীন অনাথ, মায়ানমার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার চিহ্ন বহনকারী বৃদ্ধ এবং তাদের বর্বর অত্যাচারের শিকার নারীদের দেখেছি। নিহত নিকটাত্মীয়দের শোকে ক্রন্দনরত আর নিখোঁজ আত্মীয়দের জন্য অপেক্ষারত নারী-পুরুষ ও শিশুর আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাশ ভারী হয়ে আছে। এর মাঝেও এসব মানুষের গরু, ছাগল, গয়নাগাটি এবং অর্থসম্পদ লুটের মত নৃশংসতার অভিযোগও আমরা পেয়েছি। পাহাড়ে, টিলায় কিম্বা খালি জায়গায় একটা থাকার জায়গা পেতে ক্ষমতাসীনদের চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়ার অভিযোগও শুনতে হয়েছে আমাদের। নির্যাতিত মানুষের পাশে এসব অমানুষের অবস্থান কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এর প্রতিকার এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করি।
সফরকালে আমরা অসংখ্য বেসরকারী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নানা ত্রান তৎপরতা দেখলেও সরকারী কিম্বা আওয়ামী পরিবারের তেমন কোন কার্যক্রম দেখিনি। ১৩ তারিখে আমাদের ত্রান বিতরণে বাধা দেয়া হলেও ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে শুধু ত্রান দিতেই দেয়া হয়নি, বরং ত্রাণবাহী যানবাহনের চলাচল বন্ধ করে তিনি সরকারী পাহারায় জনসভায় ভাষণও দিয়েছেন। সরকারের এমন দ্বিমুখী আচরণের আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।
মির্জা আব্বাস আরো বলেন, অসহায় বুভুক্ষ মৃত্যুপথযাত্রী রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে আওয়ামী সরকার অদ্যাবধি কোনো প্রকার ত্রাণ সামগ্রী না পাঠিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের নামে বিবৃতি ও বক্তব্য দিয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রতারণা করছেন। ক্ষুধাতুর রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রতিদিনই গণমাধ্যমে বিএনপির ২২ ট্রাক ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে কেন বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে অনুমান করা যায় যে, বিএনপির ত্রাণ সহায়তার ভূমিকায় সরকারী দল হেরে গেছে এবং এজন্যই তাদের এতো গাত্রদাহ। বিএনপির ত্রাণ কাজে বাধা দেয়ার মতো যে অপরাধ সরকার সংঘটিত করেছে তা ধামাচাপা দিতেই তিনি অনবরত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি প্রধানমন্ত্রীকে আহবান জানাবো-অবিলম্বে দেশী-বিদেশী যত সাহায্য সহযোগিতা এবং অনুদান এসেছে তা সুষ্ঠুভাবে বন্টনের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলিতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করুন। রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনসহ সকল প্রকার ত্রাণ তৎপরতায় সেনাবাহিনী নিয়োগ করুন। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও দলের পক্ষ থেকে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই-রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো রাজনীতি নয়, আসুন দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আর্তমানবতার সেবায় কাজ করি।
জাতীয় দুর্যোগে যখন সকলের একসাথে কাজ করা কর্তব্য তখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ত্রাণ কাজে বাধা দেয়ার মত নোংরামী থেকে বিরত থাকার জন্য আমরা সরকার ও তার মাথা মোটা মন্ত্রীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। একইসাথে আমরা দেশের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং অবস্থাসম্পন্ন জনগণকে অসহায়, দু:স্থ ও নি:স্ব রোহিংগা শরনার্থীদের সেবায় এগিয়ে আসার মাধ্যমে এই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলার আহবান জানাচ্ছি।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post