সালেহ উদ্দিন
বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত ‘মাসদার হোসেন বনাম রাষ্ট্র’ মামলার মূল রায়টি লিখেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল। আড়াই বছর আগে তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি প্রয়াত হওয়ার ৫ বছর আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “যে চেতনা নিয়ে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজ করা হয়েছিলো তার বিচ্যুতি ঘটেছে। নিম্ন আদালত এখনো নির্বাহী বিভাগের পুরো আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাধীন হয়নি।” মাসদার হোসেন মামলার প্রধান আইনজীবি ছিলেন ব্যারিষ্টার এম আমীর উল ইসলাম। আইন মন্ত্রণালয়ের এ নিয়ন্ত্রণকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ব্যাত্যয় সৃষ্টি করেছে বলে তিনিও অভিমত দেন।
স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বাংলাদেশে কার্যকরভাবে পৃথক হয়নি বিচার বিভাগ। বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ এখনো নির্বাহী বিভাগের হাতে। পৃথকীকরণের আগে এ দায়িত্ব ছিলো সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। এখন সেটি নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা থাকলেও বিচার বিভাগ পৃথক হবার দশ বছরেও স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। কবে হবে তা এখনও কেউ জানে না। স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এবং সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদে ভিন্নতার কারণে মাঝে মধ্যে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এই জটিলতাকে খোদ প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা দ্বৈত শাসন হিসাবে অভিহিত করেছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের কারণে বিচার বিভাগ অকেজো হয়ে গেছে। নিম্ন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।
১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট ‘মাসদার হোসেন বনাম সরকার’ মামলার রায় দেয়। রায়ে আপিল বিভাগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত ১২ দফা নির্দেশনা দেয়। ১৯৯৯ সালে মূল রায় দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট দশ বছর ধরে রায় বাস্তবায়নের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছেন। সর্বশেষ জরুরি তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত বিধিমালা কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালে ১ নভেম্বর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের যাত্রা। শুরুতে ৪১ জন চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট, ৬০ জন অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ও ২০১ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটকে নিয়ে নিম্ন আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
সর্বস্তরের আইনজীবিরা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সকল কার্যক্রমকে স্বাগত জানালেও দুটি বিষয়ে তারা তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো নিম্ন আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় যে চারটি বিধিমালা তৈরী করা হয়েছিলো তাতে বিচারকাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পদমর্যাদার জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়োগ, বদলি ও নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখা হয়েছে। বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগে এ নিয়ন্ত্রণ ছিলো ক্ষেত্রবিশেষে সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে, যা নির্বাহী বিভাগের অধীন দুটি মন্ত্রণালয়। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে এতদিন নির্বাহী বিভাগের দুটি মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করত এখন আইন মন্ত্রণালয় করছে। এ সংক্রান্ত নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা জারি করা নিয়ে গত দু’বছর ধরে সরকারের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিরোধ তৈরী হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি খসড়া সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়েছিলো। সুপ্রিম কোর্ট খসড়াটি চূড়ান্ত করে তা জারির জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। দীর্ঘদিন বিষয়টি ফেলে রেখে আইন মন্ত্রণালয় জানায়, এটি জারির বিষয়ে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেননি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শৃঙ্খলা বিধিমালা জারির বিষয়ে আদালতের কাছে সময় চাইতে থাকেন। এ নিয়ে ১৬ বার সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে সময় দিয়েছে। কিন্তু সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত না থাকায় এটি জারি হচ্ছে না। এই বিরোধ সর্বশেষ গিয়ে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিদেশ সফরের উপর পড়েছে। নিম্ন আদালতের ১৭ জন বিচারক যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে কর্মরত আছেন তাদের বিদেশ যাওয়ার ওপর রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আইন মন্ত্রণালয় সার্কুলার জারি করে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারের পর সুপ্রিম কোর্ট অন্য এক সার্কুলারের মাধ্যমে জানায়, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া প্রেষণে থাকা বিচারকরা বিদেশ যেতে পারবেন না। যদি যান তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যকলাপ হিসাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেওয়া হয়। ওই হুশিয়ারির পর আইন মন্ত্রণালয় পাল্টা একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির অনুশাসনের পর আর কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। সুপ্রিম কোর্ট পাল্টা আরেকটি পত্রে জানায়, সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের এ সংক্রান্ত সার্কুলার আইন মন্ত্রণালয়ের সার্কুলার দ্বারা অকার্যকর করা যায় না। সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় বিচারকদের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। গত ২৫ মে আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে এক পত্র পাঠায়। তাতে উল্লেখ করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া ওই বিচারকরা বিদেশ গেলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনার সুযোগ নেই। কারণ ১৭ জন বিচারকের কেউ সার্বক্ষণিক বিচারকের দায়িত্বে নেই। তাদের বিদেশ সফর বিধি অনুযায়ী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করেছে।
সাত বছর আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে থাকা ১০৭ জন (আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বাদে) বিচারককে জরুরি ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে ফিরিয়ে দেওয়ার চিঠি দেন। কিন্তু সাত বছরেও তার এই চিঠি কার্যকর হয়নি। শুরু থেকেই সব সরকারই বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে নানা কূট কৌশলে সময়ক্ষেপন করছিলো। এখনো নানা কৌশলে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধিমালা ও স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির দোহাই দিয়ে চাকরির শৃঙ্খলা বিধিমালা জারি করা হচ্ছে না। আর স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, এটি আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধির বাইরে। যদিও আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কেই বিল প্রস্তুত করতে হবে।
এ দুটি বিষয় ছাড়াও সংবিধানের পরস্পরবিরোধী দুটি অনুচ্ছেদের কারণেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, “হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকিবে।” অন্যদিকে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হইবে।” ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে এই ক্ষমতা ছিলো সুপ্রিম কোর্টের হাতে। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে নেওয়া হয়। সরকারের কার্যপ্রনালী বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পক্ষে আইন মন্ত্রণালয় এই কার্যক্রম সম্পাদন করে। আর এই অনুচ্ছেদের সুযোগে মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনেক সময় উপেক্ষা করে। ফলে নানা কূটকৌশলে নির্বাহী বিভাগ নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই রেখে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আইন বিশেষজ্ঞরা ১১৬ অনুচ্ছেদকে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস উপলক্ষে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা এক বাণীতে অনুরূপ সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১১৬ অনুচ্ছেদের ফলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহন করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কার্যে বিঘ্ন ঘটছে।
(লেখক: ল রিপোর্টার্স ফোরামের (বাংলাদেশ) সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের আইন, বিচার ও নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক)
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
Discussion about this post