হঠাৎ করে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে পুলিশ তল্লাশি চালানোয় দলটির নেতাদের মধ্যে নানা সন্দেহ ও দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। সম্ভাব্য তিনটি কারণে এই তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এই তল্লাশিকে সরকারের রাজনৈতিক কূটকৌশল বলে মনে করছেন তাঁরা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা মনে করছেন, হঠাৎ এই তল্লাশির মাধ্যমে সরকার একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। তা হলো তারা বিএনপিকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। কেউ মনে করেন, সরকার বিএনপিকে আবারও নির্বাচনের বাইরে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটা তারই অংশ। আরেকটি মত হলো, এটা বিএনপিকে শান্তিপূর্ণ রাজনীতি থেকে বিচ্যুত করার উসকানি এবং নেতা-কর্মীদের মনোবল ভাঙার চেষ্টা।
গতকাল নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘পুলিশকে অকারণে অপব্যবহার করে বিরোধী দলের অফিস তছনছ করার মতো অপরাজনীতিকে আমরা বাংলাদেশ থেকে বিদায় করতে চাই।’
এদিকে সরকার ও আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অভিযান কোনো রাজনৈতিক কৌশল থেকে পরিচালিত হয়নি। এই অভিযান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ারও চেষ্টা নেই সরকারের। এ জন্য অভিযান চালিয়ে কিছু না পাওয়ার পর তা স্বীকার করে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে এমন অভিযানে কাউকে না কাউকে নানা উপায়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হতো।
আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, বিএনপির কার্যালয়ে নিষ্ফল অভিযানের কারণে কিছুটা বিব্রত সরকারি দল। তারা মনে করছে, গোয়েন্দাদের অদক্ষতার কারণে এই ঘটনার জন্ম হয়েছে। তবে এর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপের পক্ষে নয় সরকার। এ জন্য বিষয়টি দ্রুত চাপা পড়ে যাক—এটাই চাইছে তারা। সূত্র আরও জানায়, গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চালানো জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সাফল্য এসেছে। এ জন্য বিএনপি কার্যালয়ে অভিযানের প্রশ্নে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দ্বিমত করেননি।
তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা প্রথম আলোর সঙ্গে উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়।
গত শনিবার গুলশানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু আছে কি না, তা দেখতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। হঠাৎ করে এই অভিযান বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নেতারা নিজেদের মতো বিভিন্নভাবে বিষয়টি মূল্যায়ন করছেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। তারা আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করছে। বিএনপি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছে, সরকার সেটাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এক দিক থেকে বলা যায়, পরিবেশ নষ্ট করার অর্থ হলো বিএনপি যেভাবে এখন এগোচ্ছে তাতে বাধা দিয়ে, আবার একাকী একটা নির্বাচন করার পাঁয়তারা।
বিএনপি নেতাদের আরেকটি মূল্যায়ন হলো বিএনপি সম্প্রতি ভিশন ২০৩০ ঘোষণার পর থেকে নেতা-কর্মীরা অনেকটা চাঙা হয়েছেন। এর মধ্যে এই অভিযান চালিয়ে দলের চেয়ারপারসনকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা এবং নেতা-কর্মীদের মনোবল নষ্ট করার চেষ্টা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসনকে চাপে রাখা এবং নেতা-কর্মীদের হতাশ করার জন্য এটি সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। তারা বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেয়েছিল, এ ঘটনায় উল্টো সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই ঘটনাকে উসকানি আখ্যা দিয়ে বলেন, বিএনপি যখন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক চর্চা শুরু করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে, ‘ভিশন ২০৩০’ দিয়েছে, এর পরপরই বিএনপির নেত্রীর কার্যালয়ে নজিরবিহীন আগ্রাসন হয়েছে।
আর বিএনপির বাইরে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই অভিযানকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করছেন। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, একটি রাজনৈতিক দল যার প্রধান তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর কার্যালয়ে এভাবে তল্লাশি চালানো কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এর মাধ্যমে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আরও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
আবার অনেকে মনে করছেন, তল্লাশির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, তাই এটা নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক হবে না। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে পুলিশ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। তল্লাশি শেষে তারা লিখিত দিয়েছে যে কিছু পায়নি। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এটি অনেকটা রুটিন ওয়ার্ক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকার সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে, তাঁকেই এর দায় বহন করতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব অভিযোগ করেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে তল্লাশির আইনি দিক তুলে ধরেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন। তিনি অভিযোগ করেন, তল্লাশির সময় ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৬ ও ১০৩ ধারা মানা হয়নি। এ রকম তল্লাশির সময় স্থানীয় দুজন গণমান্য ব্যক্তিকে সঙ্গে রাখতে হয়। তা হয়নি।
বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ
খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির প্রতিবাদে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ করে বিএনপি। জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২টি জেলায় বিক্ষোভে পুলিশ বাধা দেয়।
বিএনপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, বাড্ডা থানা বিএনপির মিছিলে পুলিশের হামলায় ১৫ জন আহত হন, ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপির মিছিল পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
স্বেচ্ছাসেবক দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, রাজধানীর মতিঝিলে তাদের মিছিলে পুলিশ হামলা চালালে ১০-১২ জন আহত হন। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদল ও যুবদল বিক্ষোভ মিছিল করে।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা জানান, ঝালকাঠিতে বিএনপির বিক্ষোভের পর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলামসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফরিদপুরে যুবদলের মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা করে। এ ছাড়া বরিশাল, পাবনা, নীলফামারী, বগুড়া, দিনাজপুর, সিলেট, ঝিনাইদহ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিক্ষোভে পুলিশ বাধা দেয়।
২৪ মে ঢাকায় জনসভা
খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশি তল্লাশির প্রতিবাদে ২৪ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা এবং পরদিন ২৫ মে ঢাকাসহ সারা দেশে মিছিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। গতকাল রাতে স্থায়ী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে সভা সূত্রে জানা গেছে। তবে বিএনপি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এ কর্মসূচির কথা জানায়নি।
খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির এ সভা হয়। এতে মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ স্থানীয় কমিটির ১০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post