পহেলা বৈশাখের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ক্যান্টিনে গরুর মাংসের তেহারি রান্না করায় হিন্দু ধর্মালম্বীসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যান্টিনে ভাংচুর চালায় ও ক্যান্টিন মালিককে মারধর করে। তখন চারুকলা অনুষদের ডিন মারপত জানা যায়, চারুকলা ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না করা আগে থেকেই নিষিদ্ধ। ক্যান্টিন ভাংচুর ও গরুর মাংস নিষিদ্ধের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের সর্বস্তরের ও ইসলামপ্রিয় মানুষ ব্যপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
অল্প কিছু সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীর জন্য চারুকলা ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না করা নিষিদ্ধ থাকলেও জানা গেছে সেখানে শূকরের মাংস রান্না করা বৈধ। অথচ মুসলমানদের জন্য শূকরের মাংস সম্পূর্ণ হারাম।
চারুকলার ঘটনা নিয়ে আজকের যুগান্তরের একটি রিপোর্ট মারপত এই ভয়ংকর তথ্য জানা গেছে। যুগান্তরকে ক্যান্টিন মালিক জাকির জানিয়েছেন- ‘১৯তম ব্যাচের সুজিতসহ বেশ কয়েকজন আমাকে শূকরের মাংস রান্না করতে দিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন তখন তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
এদিকে ক্যান্টিন ভাংচুরের পেছনে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি জড়িত বলেও যুগান্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
চারুকলা ক্যান্টিনের মালিক এবং একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে গত ২৭ মার্চ থেকে বৈশাখ উদযাপন কমিটির মাধ্যমে মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিতদের ক্যান্টিন থেকে দুই বেলা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছিল। ৪০ হাজার টাকা দেয়ার পরও পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত ক্যান্টিন মালিকের পাওনা দাঁড়ায় এক লাখ টাকা। এর মধ্যে ছাত্রলীগ ক্যান্টিন মালিকের কাছে ৭০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও পহেলা বৈশাখ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সাগর হোসেন সোহাগ এই টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ক্যান্টিন মালিক মো. জাকির জানান, বৈশাখ উদযাপনের দায়িত্বে ছিল ১৮ এবং ১৯ ব্যাচের ছাত্রদের। সব কিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছিল। পহেলা বৈশাখের দিন সব ধর্মের মানুষের জন্য মোরগ-পোলাও, মুসলমানদের জন্য গরুর তেহারি এবং নিরামিষভোজীদের জন্য খিচুড়ি রান্না করা হয়।
ক্যান্টিনের কর্মচারী আনিসুর রহমান সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, ‘সোহাগ ভাই (ছাত্রলীগ নেতা) আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন ক্যান্টিনে কী আছে? আইটেমগুলো বলার পর তিনি ছয় প্যাকেট গরুর তেহারি নিয়ে যেতে বলেন। আমি ছয় প্যাকেট নিয়ে গেলে তিনি আরও ২০০ প্যাকেট তেহারি নিয়ে যেতে বলেন। একটি ভ্যানে করে ২০০ প্যাকেট তেহারি নিয়ে যাওয়ার পর আরও ১০০ প্যাকেট চান। ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা হলে সকাল ৮টার দিকে ছাত্রলীগ নেতা সুস্ময় দে ওম (কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক), তন্ময় দেবনাথের (চারুকলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে ক্যান্টিনে ভাংচুর চালায়। তারা বলেন, ক্যান্টিনে গুরুর মাংস রান্না করা যাবে না। তন্ময় ও সুস্ময় দু’জনই ২১তম ব্যাচের এবং জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী।’
ক্যান্টিন মালিক জানান, হামলার সময় প্রায় এক হাজার প্যাকেট খাবার নষ্ট করা হয়েছে। ক্যান্টিনের আসবাবপত্র ও ফ্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে পাঁচ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিনি জানান, ইতোপূর্বে এই ক্যান্টিনেই বহুবার গরুর মাংস রান্না করা হয়েছে। গত পহেলা ফাগুনেও গরুর মাংস রান্না করা হয়। সেই মাংস খেয়েছেন এমন তিন ছাত্রলীগ নেতার নামও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘১৯তম ব্যাচের সুজিতসহ বেশ কয়েকজন আমাকে শূকরের মাংস রান্না করতে দিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন তখনও তো কোনো সমস্যা হয়নি।’
চারুকলার ২১ ব্যাচের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা যদি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করি তাহলে গরুর মাংস রান্না করা কখনওই নিষিদ্ধ করতে বলতে পারি না। সব আইটেম রান্না হবে, যিনি যেটা খেতে চান খাবেন। কাউকে তো জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতা সাগর হোসেন সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই। আমি বৈশাখের র্যালি শেষ করে এসে শুনলাম সবকিছু বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘এখানে তো হিন্দু-মুসলমান সবাই আছে। তাই গরুর মাংস রান্না হয় না। কিন্তু পহেলা বৈশাখের সকালে কাউকে কিছু না বলে ক্যান্টিন মালিক গরুর তেহারি রান্না করেন। যারা হিন্দু ছেলে ছিল তাদের সেন্টিমেন্টে লাগে।’ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত নই। আমি চাঁদার বিষয়ে কিছু জানিও না।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু চারুকলায় হিন্দু-মুসলমান সবাই আছে, তাই সাধারণত সেখানে গরুর মাংস রান্না করা হয় না। তবে পহেলা বৈশাখের দিনের বিষয়টিকে আমরা মোটেও সহজভাবে নিচ্ছি না। যারা বৈশাখ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিল তাদের এখানে দুর্বলতা ছিল। পুরো ঘটনাটিই আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছে। চারুকলা অনুষদ এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। এর পাশাপাশি আমরাও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।
এদিকে, চারুকলা ক্যান্টিনে শূকরের মাংস রান্না হওয়া খবরে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থী থাকার উসিলায় গরুর মাংস রান্না করা নিষিদ্ধ, সেখানে মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ শুকরের মাংস কি করে রান্না করা হয়?
অনেকের মতে, শুকরের মাংসভোজী কারো জন্য শূকরের মাংস রান্না করাটা অন্যায়ের কিছু না। কিন্তু যখন ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীর উসিলায় গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হয়, তখনই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তাদের প্রশ্ন চারুকলায় আসলে কারা বসে আছে? এটাতো বিজেপি শাসিত কোনো অঙ্গরাজ্য নয়, এটা ৯০ শতাংশ মুসলামানের একটি স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। গুটিকয় সনাতন ধর্মের লোকের কারনে সিংহভাগ মুসলমানকে গরুর মাংস থেকে বিরত রাখার কোনো সুযোগ নেই।
Discussion about this post