মঈন খান
ভারত নির্মিত ‘গুন্ডে’ সিনেমার কথা নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা। যে সিনেমার শুরুতেই বলা হয়েছিল “১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণামেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম।” এ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর সর্বমহলে নিন্দার ঝড় উঠলেও তাতে কোন লাভ বা অগ্রগতির দেখা মেলেনি। ‘গুন্ডে’-তে যেভাবে ১৯৭১-র যুদ্ধকে বর্ণনা করা হয়েছিল, তার জন্য ছবিটির নির্মাতা যশরাজ ফিল্মস দু:খ প্রকাশ করলেও ছবিটির প্রদর্শন বাতিল করার বা তাতে পরিবর্তন আনার কোনও পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
এটি ছিল সিনেমার কথা। কিন্তু সিনেমা হলেও এদেশের জনগণ তখন এটি হালকা ভাবে নিতে পারেনি। কারণ, এ সিনেমা ভারত সরকারের সেন্সরবোর্ড পার হয়ে তবেই মুক্তি পেয়েছিল। আর এতে তাদের মৌন সমর্থনের ব্যাপারটা খুবই স্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপিসহ বেশ কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখেও গুন্ডের সেই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। কেউ কেউ তো আক্ষেপ করে এভাবেও বলেছে যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে ভারত নতুন আরেক পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছে। কেউবা রামের রাজত্ব ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত দেশজুড়ে গুঞ্জন চলছে। গুঞ্জনটা অবশ্য হঠাৎ করেও শুরু হয়নি। অবৈধ উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করতে গিয়ে ভারতের সাথে হাসিনা ওয়াজেদের কি কি গোপন চুক্তি হয়ে আছে তাও জাতির কাছে স্পষ্ট নয়। তবে ধীরে ধীরে তা ক্রমদৃশ্যমান হচ্ছে এ কথা সত্য। দেশের স্বার্থ রক্ষার বালাই না থাকলেও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ইতোমধ্যেই ভারতকে সড়কপথে এবং নৌপথে ট্রানজিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কখনও বিনা শুল্কে আর কখনও নামমাত্র শুল্কে দেয়া হচ্ছে এসব ট্রানজিট। এরইমধ্যে ভারত আকাশসীমা ব্যবহারের জন্যও প্রস্তাব করেছে। দেশের অভ্যন্তরে ইন্টারনেটের বেহাল অবস্থা রেখেই কোন প্রকার জানাজানি ছাড়াই গোপনে সরবরাহ করা হচ্ছে ব্যান্ডউইথ। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে সুন্দরবনের অদূরে রামপালে নির্মান করা হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প।
প্রতিদিন সীমান্ত দিয়ে এদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে অবৈধ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক আরো কত কি! এমনকি হলি আর্টিসানে সংঘটিত দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক একে-২২ রাইফেলগুলোও ছিল ভারতের তৈরী। জেনে রাখা ভালো যে, এ হামলার পর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানী আয়ের উৎস তৈরী পোষাক খাত। পিছিয়ে যায় জাপান, কোরিয়া ও গণচীন পরিচালিত বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প। ক্ষুন্ন হয় বহির্বিশ্বে অর্জিত এদেশের সুনাম। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে।
আর সীমান্ত হত্যা? এ নিয়ে কথা বলতে বলতে এদেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, আলেম-উলামা, মানবাধিকার কর্মী, আর আইনজীবিদের গলার স্বর ক্ষীন হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিনের ইসরাইলী সীমান্ত ছাড়া বিশ্বের আর কোন সীমান্তে এভাবে পাখির মত গুলি করে মানুষ মারা হয় কিনা আমার জানা নেই। এছাড়াও সীমান্তের এপাড়ে এসে মাঝে মধ্যেই বিএসএফ যেসব কাজ করে তার সাথে শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধেরই তুলনা করা চলে।
লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নদীপথে ট্রানজিট নিলেও অভিন্ন নদীসমূহে বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে সবুজ শ্যামল এই দেশটাকে মরুকরণের কাজ শুরু করেছে ভারত অনেক আগে থেকেই। উজানে একের পর এক বাঁধ নির্মান করে এদেশের কৃষি ও জলবায়ুর যে ক্ষতি ভারত করেছে তা কোন শত্রু রাষ্ট্রও অন্য কোন শত্রু রাষ্ট্রের জন্য করে না। অবশ্য এজন্য ভারত নিজেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যারফলে ফারাক্কা ভেঙে দেয়া দাবি উঠছে খোদ ভারতের অভ্যন্তর থেকেও। উজানে গজলডোবাসহ শত শত বাঁধ নির্মান করে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেয়ার সব আয়োজনই ভারত সম্পন্ন করে রেখেছে। তিস্তা নিয়ে চিৎকার করতে করতে এদেশের ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবিরাও হতাশ হয়ে পড়েছে। দেরিতে হলেও প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হচ্ছে ভারতের এ অদ্ভূত ধরণের বন্ধুত্ব নিয়ে।
যাইহোক, এতকিছুর পরেও আধিপত্যবাদী ভারতের খায়েশ পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশকে সিকিমে পরিণত করার অভিলাষে এখন তারা বাংলাদেশের সাথে অদ্ভূত রকমের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে চায়। চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কেনার পর থেকেই ভারতের দাবিকৃত কথিত এই প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করানোর জন্য ভারতের আগ্রহের যেন অন্ত নেই। অনির্বাচিত সরকারের সুযোগ নিয়ে তড়িঘড়ি করে ভারত এ অযাচিত চুক্তি বা সমঝোতা করিয়ে নিতে চায়। জনমতের তোয়াক্কা না করে অবশ্য এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতে পৌঁছেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানাতো হয়েছে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে দুই- দুইটি প্রতিরক্ষা সমঝোতা হচ্ছে। ২৫ বছর মেয়াদী এই গোলামীর চুক্তিকে কৌশল করে বলা হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদী সমঝোতা। সাথে আবার এটাও বলা হচ্ছে যে, এটার মেয়াদ ২৫ বছর নয়- কিন্তু পাঁচ বছর পর পর সাধারণত এই সমঝোতা-স্মারকগুলো আপনি আপনি নবায়ন হয়ে যায়।
ভারতের সাথে এযাবতকালে প্রকাশ্যে ও গোপনে যত চুক্তিই হয়েছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারত এই ছোট্ট দেশটি থেকে শুধুই নিয়েছে। কি যে দিয়েছে তা হিসেব করে বলাও মুশকিল। এসব কথা বললে একশ্রেণীর বাংলাদেশী বলতে চায় ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে। তাই এসব অবিচার মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। তখন প্রশ্ন থেকে যায় লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত এদেশ কি শুধুই ভারতের দান? স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে এদেশের মানুষ যে ত্যাগের নজরানা পেশ করেছে তার মূল্য রইল কোথায়? দল মত নির্বিশেষে এদেশের আপামর জনগণের ভাবার মোক্ষম সময় এসেছে- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়… ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post