আহমেদ বায়েজীদ
বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে নতুন এক মেরুকরণের পূর্বাভাস শুরু হয়েছে। চীন-রাশিয়া-পাকিস্তানের ত্রিপাক্ষিক জোট গঠনের ঘোষণা এসেছে এই পূর্বাভাস হিসেবে। দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও রাশিয়ার সাথে মধ্যম শক্তির পাকিস্তানের জোট গঠনের সম্ভাবনায় নড়েচড়ে বসছেন সামরিক বিশ্লেষকরা। হঠাৎ করেই সপ্তাহের শুরুতে এমন একটি খবর প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম। এরপর থেকেই বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। যদিও বলা হচ্ছে, দেশ তিনটি আফগানিস্তান ইস্যুতে এক সাথে কাজ করার জন্য জোটবদ্ধ হচ্ছে, তথাপি এ জোটকে শুধু আফগানিস্তানের গণ্ডিতে কল্পনা করতে রাজি নয় আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল। বিশ্বে ক্ষমতার লড়াইয়ে পারমাণবিক শক্তিধর তিনটি দেশের ঐক্য কী প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ।
পাকিস্তানের মিডিয়া বলছে, আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে চায় চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান। দেশ তিনটি মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করেই আফগান যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। এই যুদ্ধ জিইয়ে রেখে তারা হয়তো বছরের পর বছর মধ্য এশিয়ার দেশটিতে অবস্থান করতে চাইছে। এমন আশঙ্কা থেকেই পাকিস্তানের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে আফগানিস্তানে জোটবদ্ধভাবে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছে চীন ও রাশিয়া।
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সাথে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে পাকিস্তানের। দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাস চালাচ্ছে বলে মনে করছে ইসলামাবাদ। এ জন্য আফগানিস্তানে সহিংসতার অবসানে তাদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সুবাদে কাবুল সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে নয়া দিল্লি। ভারতের ইশারায় আফগান সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলছে এমন নজিরও আছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকে টেক্কা দিতেও তাই আফগানিস্তানে ঢুকতে চায় পাকিস্তান। তাই দুই দিক থেকেই আফগানিস্তান ইস্যুটি পাকিস্তানের কাছে জীবন-মরণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে ভৌগলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক বিবেচনায় রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান। এক সময় এখান থেকে পরাজিত হয়ে বিদায় নেয়া দেশটি তাই আবারো এখানে জায়গা করে নেয়ার সুযোগ খুঁজছে। মধ্য এশিয়ার ভৌগলিক গুরুত্ব চীনের কাছেও কম নয়। তাদের ‘ওয়ান বেল্ট’ বাণিজ্য নীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান। আবার চীন-রাশিয়া উভয়ের কাছেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য খর্ব করার আগ্রহ। যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিতে তাই আফগানিস্তানে কাজ করার বিষয়ে পাকিস্তানের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে দেশ দু’টি। উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে তা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জন্য। আফগানিস্তানের প্রশাসনে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-চীন-পাকিস্তান দেশটিতে প্রবেশ করলে সব হিসাব পাল্টে যেতে পারে। যেমনটি দেখা গেছে সিরিয়ায়। বাশার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে থোড়াই কেয়ার করেছে। আফগানিস্তানেও যে তারা প্রভাব বিস্তার করতেই আসবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাথে বাড়তি হিসেবে এখানে সাথে থাকবে চীন ও পাকিস্তান।
চীন-রাশিয়া-পাকিস্তানের ত্রিভূজ জোট নিয়ে বিশ্বে জল্পনা-কল্পনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। ঘটনার সূত্রপাত দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধের সময় রাশিয়ার চীনকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ও যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সে সময় চীনকে সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া। একই সাথে নৌমহড়া করেছে বৃহৎ দু’টি শক্তি। আমেরিকা ইস্যুতে মস্কো আর বেইজিংয়ের মধ্যে সহাবস্থান অনেক বছর ধরেই। তবে এই ঘটনার পর সেটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে ভারতের ভূমিকাও গুরুত্ব পেয়েছে দেশ দু’টির কাছে। রাশিয়ার সাথে কয়েক দশকের সম্পর্ক থাকলেও ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকেছে অধিক হারে। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা মস্কো। কিন্তু হঠাৎ করে দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রপ্রীতি তাদেরকে বিকল্প চিন্তা করতে উৎসাহীত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত চৌহদ্দিতে বাঁধা পরা ভারতকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা রাশিয়া দ্বিতীয়বার ভাববে না সেটাই স্বাভাবিক। মস্কো হয়তো এর মাধ্যমে নয়া দিল্লিকে তার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কড়া বার্তাও দিতে চাইছে। অন্য দিকে পাকিস্তানের সাথে কয়েক দশকের সম্পর্ক গুটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও এখন ভারতকে কাছে টানছে। যার ফলে পাকিস্তান ও রাশিয়া নিজ নিজ মিত্রকে হারিয়ে একে অপরের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। রাশিয়ার কাছে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতের বিকল্প হিসেবে পাকিস্তান, আবার পাকিস্তানের কাছে বৃহৎশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া স্থান করে নিয়েছে। যার অংশ হিসেবেই গত বছরের শেষ দিকে পাক-ভারত উত্তেজনার সময় পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। আর ভারতের সাথে আঞ্চলিক বিরোধ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈশ্বিক নেতৃত্বের বিরোধ চীনকেও নিয়ে এসেছে এই সমীকরণের আওতায়। যার ফলে সহজেই চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের জোটবদ্ধ হওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছে।
শক্তিশালী এই তিনটি দেশের জোট গঠনের বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে বিশ্ব মিডিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক হাফিংটন পোস্টে কিছুদিন আগে প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘বড় ধরনের একটি পরিবর্তনের সন্নিকটে বিশ্ব ব্যবস্থা। সম্ভাব্য একটি জোট গঠিত হতে পারে, যা এযাবত কালে কখনো হয়নি। চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তানের এই জোট বিশ্ব ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে এবং বৃহত্তর বৈরিতার জন্ম দেবে’। পত্রিকাটি আরো বলছে, মস্কোর এই উদ্যোগের নেপথ্যে যে শুধু আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য আনা তাই নয়, তারা সম্ভবত বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে আসার জায়গা করে নিতে চাইছে।
ত্রিভূজ এই জোটের পরিধি কিংবা এর ক্ষেত্র কতখানি হবে সেটি বুঝতে আরো অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে হয়তো। তবে যদি এই জোট আফগানিস্তানের পরিধি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিচরণ শুরু করে, তবে তা হতে পারে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। পারমাণবিক শক্তিধর তিনটি দেশ, যাদের মধ্যে একটি আবার বিশ্ব বাণিজ্যের নেতা- তারা একসাথে কাজ করলে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের জন্য এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর কিছু থাকবে না সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কৌশলগত কারণে দুই মহাদেশের দুই উদীয়মান শক্তি ইরান ও তুরস্ক এই জোটকে সমর্থন করবে সেটাই স্বাভাবিক।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post