অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে বিদেশ থেকে গৃহীত দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েই যাচ্ছে, সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ সবচেয়ে বেশি এবং এ ঋণের ঝুঁকিও বেশি। সরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেশি। ইদানীং বৈশ্বিক মন্দায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এখন বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডলার সংকটে নিয়মিত ঋণ শোধ করতে না পারায় এর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এতে ঋণের অর্থও বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েই ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ১৪ বছরে দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে সাত হাজার ৩৪৬ কোটি ডলার বা ৩২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
২০০৮ সালের শেষে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল দুই হাজার ২৭৯ কোটি ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬২৫ কোটি ডলারে, অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ৩২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে ওই সময়ে মোট দেশজ উৎপাদন বেশি বেড়েছে, সে তুলনায় বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে কম, যে কারণে জিডিপির আকারের অনুপাতে বিদেশি ঋণ এখন আগের চেয়ে কমেছে। ২০০৮ সালে দেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে। ওই সময়ে দেশের বৈদেশিক ঋণ যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জিডিপির আকার, যে কারণে আগের চেয়ে এখন জিডিপির হিসাবে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত কমেছে।
২০২২ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে। গত বছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ বছরে বাংলাদেশের ঋণ আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ডেট রিপোর্ট বা বৈশ্বিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৩-এর তথ্যানুসারে, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ দশমিক শূন্য ১২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৭১২ কোটি ডলার; ২০২১ সালে যা ছিল ৯১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ১৪৭ কোটি ডলারের বেশি। সেই হিসাবে এক বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি।
২০২১ সালে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সম্মিলিত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ছিল ৯ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ ট্রিলিয়ন বা ৯ লাখ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এ সময়ে সম্মিলিতভাবে এসব দেশের বিদেশি ঋণ কমেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের বৈশ্বিক ঋণ প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট বিদেশি ঋণ ছিল ২৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন (২ হাজার ৬৫২ কোটি) ডলার; ২০১৮ সালে যা ৫৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন (৫ হাজার ৭১২ কোটি) ডলার ও ২০২২ সালে তা ৯৭ বিলিয়ন (৯ হাজার ৭০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর ১২ বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। ২০২২ সালে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বিনিয়োগের গতি প্রকৃতি বদলে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে। দেশের ঋণ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হলেও সামগ্রিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনো ৪০ শতাংশের নিচে। তবে বিদেশি ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প হচ্ছে, সেখান থেকে বিদেশি মুদ্রা আয়ের তেমন সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে টাকার যেভাবে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তাতে সরকারের ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে রাজস্ব আয় আনুপাতিক হারে না বাড়লে ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৫ লাখ পাঁচ হাজার ৩৬৩ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে তিন লাখ ৫৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই ঋণ জিডিপির ৩৪ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ এক লাখ পাঁচ হাজার ২৫২ টাকা, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৯ হাজার ৬৫২ টাকা।
বাংলাদেশের সুশাসন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দাতাদের বক্তব্য এখন নিয়মিত ব্যাপার। একদিকে শর্তের বেড়াজাল, অন্যদিকে সাহায্যপ্রবাহ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার অভাব, দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রভৃতি কারণে সাহায্যের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিও একটি উদ্বেগজনক চিত্র। এরপর লুটপাট করে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি বাংলাদেশের নৈমিত্তিক ঘটনা।
একদিকে ঋণ বাড়ছে অন্যদিকে মেগা প্রজেক্টের নামে বাড়ছে লুটপাট। সব মিলে বিশাল এক খাদের কিনারায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এর মূলে রয়েছে অপশাসন ও গণতন্ত্রহীনতা। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতন্ত্রের উন্নয়ন অন্যতম পূর্বশর্ত। যার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
Discussion about this post