বহুদিন থেকেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ার দাবি করে যাচ্ছিল ভারত। বাংলাদেশের পূর্বে থাকা ৭ টি রাজ্যে কলকাতা বন্দর থেকে মালামাল পরিবহন করতে ভারতকে পাড়ি দিতে দেড় হাজার কিলোমিটার থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত। অথচ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে গেলে সেটা ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে নেমে আসে। তাই ভারতের জন্য ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া জরুরি। যদিও আগে থেকেই ট্রানজিট সুবিধা নিচ্ছে ভারত কিন্তু তাদের চাওয়া ছিল মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে মালামাল পরিবহন করার। এতে তাদের খরচ আরো অনেক কমে আসবে।
ভারত বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের দাবি করলেও এর জন্য উপযুক্ত বিনিময় দিতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টা ঝুলে ছিল। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশও নেপাল ও ভূটানে ট্রানজিট দাবি করে আসছিল। এই দাবির ব্যাপারে ভারতের রহস্যজনক নীরবতাও দায়ি ভারতের বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা পেতে দেরি হওয়ার জন্য।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্থায়ী আদেশ জারি করেছে বাংলাদেশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারি করা ২৪ এপ্রিলের ওই আদেশে দুটি বন্দর থেকে দেশটির পণ্য পরিবহনে আটটি রুট ছাড়াও বিভিন্ন চার্জ ও ফি ঠিক করা হয়েছে।
এর ফলে ভারত তাদের পণ্য বাংলাদেশর বন্দর ব্যবহার করে তাদের সাতটি রাজ্যে পাঠাতে পারবে। এতে তাদের সময় ও ব্যয় কমবে। ভারতের সুবিধার ব্যাপারটা স্পষ্ট হলেও বাংলাদেশের স্বার্থ একেবারেই উপেক্ষিত হয়েছে। যদিও প্রয়োজন ভারতের কিন্তু দায় হয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ২০১০ সালে ট্রানজিটের জন্য যে সুবিধা ও ট্যাক্স আদায় করতো ভারতের জন্য এখন তা এতই কমিয়ে দিয়েছে যে, ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট সুবিধা থেকে আয় করাতো দূরের কথা উল্টো কোটি কোটি দলার লোকসান গুণতে হবে। ভারতকে সুবিধা দেওয়ার আমাদের কেন লোকসান গুণতে হবে?
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য সরবরাহ করতে দুই দেশের মধ্যে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চুক্তি হয়েছিল যার নাম “এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম এন্ড মোংলা পোর্টস ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু এন্ড ফ্রম ইন্ডিয়া।”
ওই চুক্তির পর এ কার্যক্রম নিয়ে উভয় দেশ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি চূড়ান্ত করে। তবে শুল্কায়ন কার্যক্রম কীভাবে সম্পন্ন করা হবে কিংবা পণ্যচালান কী প্রক্রিয়া আনা-নেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত না হওয়ায় এ ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম পুরোদমে চালু করা যায়নি। এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় পণ্যের চালান বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসাম ও মেঘালয়ে নেওয়া হয়।
২৪ এপ্রিল দেওয়া রাজস্ব বোর্ডের নতুন আদেশ অনুযায়ী, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি মেট্রিক টনের জন্য ২০ টাকা, অথচ ২০১০ সালে এটি ছিল ১০০০ টাকা। এছাড়া ডকুমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ ফি প্রতি চালানোর জন্য ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট চার্জ প্রতি কন্টেইনার বা ট্রাক ৮৫ টাকা, বিবিধ প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা। যাও একেবারেই নামমাত্র।
২৫ টন করে পণ্য বহনকারী ২০ ফুটের (টিইইউ) প্রতিটি কনটেইনারের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা হারে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হবে ভারতকে। যদিও ২০১০ সালে এ হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০১০-এর নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ ধার্য হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নামমাত্র মূল্যে বন্দর ও ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের আয় তো হবেই না বরং এই ট্রানজিট সুবিধা দিতে গিতে যে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা করতে হবে তার খরচও উঠবে না।
এদিকে ভারত স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও ট্রানজিট সুবিধা পেলেও বাংলাদেশের দাবির বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ভারতকে স্থায়ীভাবে বন্দর ব্যবহার ও শত শত কিলোমিটার ট্রানজিট সুবিধা দিচ্ছে ৮ টি রুটে। পক্ষান্তরে মাত্র একটি রুটে ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ভারত স্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দেয় না। তাদের ইচ্ছেনুযায়ী ও কিছু নির্দিষ্ট পণ্যে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়।
এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা হয়ে নেপালের কাকরভিটা পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ভারত স্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দেয় না। এই সড়ক স্থায়ীভাবে ব্যবহার করার সুযোগ পেলে নেপাল ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়বে।”
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর মূলত নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আহ্বান জানাই, যাতে কাকরভিটা পর্যন্ত ভারতের অংশের সড়কটি বাংলাদেশি পণ্য নেপাল-ভুটানে পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।”
এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, ভারতের পণ্য চালান চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে আটটি রুটে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলবন্দর হয়ে ভারতে নেয়া যাবে। এগুলো হলো, চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-তামাবিল ডাউকি, মোংলা বন্দর-তামাবিল-ডাউকি, চট্টগ্রাম বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, মোংলা বন্দর-শেওলা-সুতারকান্দি, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।
Discussion about this post