আজ ১০ নভেম্বর। নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে নূর হোসেনসহ তিনজনকে হত্যা করে স্বৈরাচার এরশাদ। তখন দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একত্র হয়ে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে। তাদের একমাত্র দাবি ছিল জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাবিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা।
অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকায় একটি মিছিলে নূর হোসেন অংশ নেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেন: “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” । মিছিলটি ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি আসলে স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশবাহিনীর গুলিতে নূর হোসেনসহ মোট তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হন। এসময় বহু আন্দোলনকারী আহত হন। নিহত অপর দুই ব্যক্তি হলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হূদা বাবুল এবং আমিনুল হূদা টিটু।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বিরোধী দলগুলো ১১ ও ১২ই নভেম্বর সারা দেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; ফলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরো ত্বরান্বিত হয়। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ও নানা ঘটনা ও উপঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরশাদ পদত্যাগ করলে বাংলাদেশে দুটি হ্যাঁ-না ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সর্বোচ্চ আসন পান। তবে তিনি সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন পাননি। জামায়াতে ইসলামী দেশে একটি শান্তিপূর্ণ সরকার গঠনের লক্ষ্যে কোনো চাহিদা ছাড়াই বিএনপিকে সমর্থন দেয় সরকার গঠনের জন্য। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নেতা ও মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া নির্বাচিত হন।
এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নূর হোসেন এর মৃত্যুর দিনটি সরকারিভাবে উদযাপনে উদ্যোগ গৃহীত হয়। দিনটিকে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ই নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলেও আওয়ামী লীগ এটিকে শহীদ নূর হোসেন দিবস করার জন্য দাবি জানায় এবং এই নামটি এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে। ১৯৯৬ সালে এরশাদ, নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর দল জাতীয় পার্টি এখন ১০ই নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।
নূর হোসেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি বছরের ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশে “নূর হোসেন দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। এছাড়া তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তাঁর নামানুসারে সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন চত্বর। ১০ই নভেম্বর তাঁর মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বে তোলা তাঁর গায়ে লেখাযুক্ত আন্দোলনরত অবস্থার ছবিটি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
নূর হোসেন বিএনপির কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগের কর্মী। দুঃখজনক ব্যাপার হলো গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেওয়া আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেনের দল ও তার নেতা শেখ হাসিনা গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশে স্বৈরাচার হয়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে।
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর মাত্র তিনজনের মৃত্যু দেশে মারাত্মক আলোড়ন তৈরি করেছে ও এরশাদ স্বৈরাচার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। বর্তমানে হাসিনা এত বড় স্বৈরাচার হয়েছে যে ৩০০ জনের মৃত্যুও এখন মামুলি ব্যাপার মনে হয়। শেখ হাসিনার তুলনায় এরশাদ ছিল চুনোপুটি স্বৈরাচার।
গত এক যুগে হাসিনা তার গুণ্ডা বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ খুন করেছে। গুম করেছে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে। দেশের সব রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। এখন আর কেউ ভোট দিতে পারে না। মিছিল ও সমাবেশ করতে হয় পুলিশের অনুমতি নিয়ে একটু আধটু। তারপরও পুলিশ পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে রাখে। আওয়ামীলীগ ছাড়া অন্য দলগুলো নিঃসংকোচে তাদের পার্টি অফিস পর্যন্ত খুলতে পারে না।
নূর হোসেনের দলই আজ দেশের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার। নূর হোসেন দিবসে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়াই আমাদের চাওয়া।
Discussion about this post