ডা. মু. মুজাহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য যার অবদান জাতিকে স্বীকার করতেই হবে তিনি হচ্ছেন আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় শাহ আব্দুল হান্নান। শাহ আব্দুল হান্নান আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট ও বরেণ্য ব্যক্তি ছিলেন। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। নিবেদিতপ্রাণ নিষ্ঠাবান ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক সমকালীন বিভিন্ন ইস্যুতে তার দ্বিধাহীন সংকীর্ণতামুক্ত ও সুচিন্তিত মতামত মূল্যায়ন এবং সক্রিয় ভূমিকা তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। তিনি নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রে ছিলেন আপোষহীন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে অপপ্রচার ও আক্রমণ চলছে তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সমালোচিত জবাব প্রদানে যেসব ব্যক্তিত্ব অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলছেন জনাব শাহ আব্দুল হান্নান তাদের অন্যতম। জনাব শাহ আব্দুল হান্নান শত ব্যস্ততার মাঝেও দেশ ও জাতির কল্যাণে যেকোনো উদ্যোগে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন ইসলামী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিববিদ ও সমাজসেবক। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন।
এছাড়াও তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও নয়া দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান ১৯৩৯ সালের ১লা জানুয়াারি বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শাহ আব্দুল হান্নান তার কর্মজীবন শিক্ষকতার পেশা দিয়ে শুরু করেন। তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিসে যোগ দেন এবং ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকারের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক, সমাজ কল্যাণ ও সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ছিলেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি ভ্যাট চালুর অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলামের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী ছিলেন। তিনি যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন তখন একদিন তার হাইস্কুলের সহকারী প্রধানশিক্ষক ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে ক্লাসের মধ্যে আপত্তিকর মন্তব্য করেন, শিক্ষকটি ছিলেন হিন্দু। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শিক্ষকের করা মন্তব্যের প্রতিবাদ করেন ও বুঝানোর চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে শিক্ষক ভুল বুঝতে পারেন ও তার কথা মেনে নেন। তিনি বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন, ভালো বক্তা ও বিতার্কিক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি বিএ পরীক্ষায় সারা দেশে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর ল’ কোর্সের পড়া পড়ে প্রায় শেষ করেছিলেন, যদিও পরে পরীক্ষা দেননি। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি সারাদেশে ৫২ তম ও পূর্ব পাকিস্তানে ২০ তম স্থান অধিকার করেন।
তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ১৯৭২ সালে যোগদান করে অনেক দায়িত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান আমল থেকে পাওয়া পুরনো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন।
তিনি ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক হন, সেখানে তিনি দু’বছর ছিলেন। দুর্নীতি দমন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি তিনি দুর্নীতি দমনের নামে যাতে কোন মানুষকে অযথা হয়রানি করা না হয় সে ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্ণর থাকাকালীন ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আইনগত যেসব বিষয় ছিল তা তিনি অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পাদন, সংস্কার ও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিশেষভাবে তিনি ইসলামী ব্যাংকের জন্য কাজ করেন। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান আইন সংস্কার করেন। ফলে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের জন্য যে প্রতিবন্ধকতা ছিল তা দূর হয়ে যায়। আইনে ছিল, কোন ব্যাংক ব্যবসা করতে পারবে না, সেখানে তিনি সংযুক্ত করেন, ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে না।
অর্থাৎ ইসলমী ব্যাংকগুলো ব্যবসা করতে পারবে। ইসলামী ব্যাংকিং এর অন্যান্য ধারাগুলোর প্রতিবন্ধকতাও তিনি দূর করে দেন। ঐ সময় তিনি আরও দুটি ইসলামী ব্যাংকের অনুমতি দেন। তিনি বিশেষভাবে চেষ্টা করেন যাতে আরও কয়েকটি ইসলামীি ব্যাংক লাইসেন্স পেতে পারে। সোসাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক তখন লাইসেন্স পায়। ব্যাংকিং সংক্রান্ত ঋণ শ্রেণীকরণ, কমার্সিয়াল ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল রাখা ও রিস্ক এনালাইসিস সংক্রান্তসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে বিআইবিএম ব্যাংকিং ম্যানেজমেন্টের উপর যে মাস্টার্স ডিগ্রী দিচ্ছে সেটিও তিনি অনুমোদন করেছেন।
এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার সমিতি ও ট্রেড ইউনিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে কৌশলী ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার ব্যবহার ও কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্ণরের নিকট অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তুরস্ক, ইরান, জাপান, কাজাকিস্তান ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন।
তার রচিত বইগুলো মানুষের চিন্তার জগতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। তার রচিত উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো : ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা, ইসলামী অর্থনীতি : দর্শন ও কর্মকৌশল, নারী সমস্যা ও ইসলাম, নারী ও বাস্তবতা, সোস্যাল ল অব ইসলাম, দেশ সমাজ ও রাজনীতি, আমার কাল আমার চিন্তা, বিশ্ব চিন্তা, সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম, উসুল আল ফিকহ, ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি ইত্যাদি।
বহুমুখী প্রতিভাধর আমাদের এই অভিভাবক গত ২ জুন ২০২১ সালে ইন্তেকাল করেন।
Discussion about this post