হাসান রূহী
১.
ইতোপূর্বে সামাজিক মাধ্যমে চাপাতি লীগ নামে পরিচিত হলেও ইদানিং তারা হাতুড়ি লীগ নামে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। এর আগে সিলেটের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বদরুললীগ নামেও বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতির পেছনে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে। সে যাইহোক, যে যেভাবে ডাকুক, দিন শেষে মিডিয়ার পাতা তাদের ছাত্রলীগ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেয়।
ছাত্র সংগঠন হিসেবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও নতুন প্রজন্মের স্মৃতিতে ছাত্রলীগ নিয়ে ভালো কোন স্মৃতি আদৌ আছে কিনা আসলেই তা খতিয়ে দেখার বিষয়। রাজনীতির ময়দানে ছাত্র রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। কিন্তু এই ছাত্র রাজনীতির দৃর্বৃত্তায়নের ফলে আজ তা ছাত্র সমাজে এক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। কেড়ে নিয়েছে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলের শান্তির ঘুম। আর এই দুর্বৃত্তায়নের শীর্ষে যে সংগঠনটি রয়েছে তার নাম ছাত্রলীগ। পত্রিকার পাতা খুললেই কোন না কোন দুঃসংবাদের শিরোনামে এ সংগঠনের নাম পাওয়া যায়। এবং এটা যে কতদিন যাবত এভাবে পাওয়া যাচ্ছে তার সঠিক হিসেব বলাও কষ্টকর কাজ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ছাত্রলীগকেই যদি ছাত্রলীগের ধারাবাহিক কর্মকান্ডের হিসেব রাখতে বলা হয় তবে তারা ছাত্রলীগ ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে।
২.
মানুষের মনটা এমন যে, সেখানে কোনকিছু একবার রেখাপাত করলে তা সারাজীবন থেকে যায়। আর মনের ওপর জোরও চলে না। শুধুমাত্র একারণেই যুগের পর যুগ পার হয়ে গেলেও শুধুমাত্র ‘বাকশাল’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথেই পূর্ব প্রজন্মের মানুষ শিউরে ওঠে। ঘৃনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের বাচনভঙ্গিতে। কিন্তু কেন? এ জবাব নতুন প্রজন্মের অনেকেরই জানা ছিল না। কারণ, ইতিহাসে অনেকেরই আগ্রহ থাকে না। ইতিহাস কেউ কেউ পড়তেও চায় না। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম নব্য এক বাকশালের দৃশ্য দেখছে প্রায় ১ যুগ ধরে। আর নব্য বাকশালের ধাক্কা খেয়ে অনেকেই ঝুঁকছেন ইতিহাসে। পড়ে দেখার চেষ্টা করছেন বাকশাল কি, কেমন ছিল বাংলাদেশের মানুষের সে দিনগুলি! সবকিছু মিলে যা দাঁড়াচ্ছে তাতে তরুণ প্রজন্মের সামনে ছাত্রলীগ এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
কিন্তু, লাজ-শরম, বুদ্ধি-বিবেকের মাথা খেয়ে ছাত্রলীগ যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসবের মাধ্যমে ছাত্রলীগ জাতিকে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে তা বিশেষ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
৩.
সরকারি চাকরীতে কোটা বৈষম্য দূর করার দাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগও খবরের শিরোনাম হওয়ার দাবি রাখে। খবরে ছাত্রলীগ এলো, তবে গুন্ডা বেশে। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে হইচই। ঘটনা কি? নিজ কক্ষে আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রীদের ডেকে শাসাচ্ছিল ছাত্রলীগ নেত্রী এশা।আর শাসানোর এক পর্যায়ে এক ছাত্রীর পা কেটে ফেলে এই নেত্রী। এরপর সাধারণ ছাত্রীদের কাছে গণধোলাই খেয়ে গলায় জুতার মালা পরে সে রাতেই হল ছাড়তে বাধ্য হয় লেডি বদরুল খ্যাত এশা। এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। সেসময় দিনে দুপুরে ছাত্রীদের বস্ত্রহরণ করে আলোচনায় আসে ছাত্রলীগ নেত্রী শ্রাবণী শায়লা। শ্রাবণী শায়লাকে সেদিন কেউ প্রতিরোধ করতে না পারলেও ভাগ্যের জোরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে এশা। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে জুতার মালা পেয়ে হল ছাড়তে বাধ্য হলেও ছাত্রলীগ কিন্তু এশাকে ফুলের মালা দিয়েই বরণ করে নিয়েছে। এর মাধ্যমে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কি বার্তা দিতে চেয়েছে তা সচেতন ব্যক্তির মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন।
শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত যৌক্তিক আন্দোলনে রূপ নেয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। দল-মত নির্বিশেষে সবাই এই বৈষম্য থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি সম্বলিত এ আন্দোলন দমাতে আদা-জল খেয়ে মাঠে নামে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের নানান হুমকি দেয়া থেকে শুরু করে তাদের তুলে নিয়ে গুম করা পর্যন্ত এমন কোন হীন কাজ নেই যে তারা করেনি। সাধারণ ছাত্রদের ওপর পুলিশের সাথে তাল মিলিয়ে একযোগে হামলা, আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ভিসির বাসভবনে হামলা-ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ, প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণার পর আন্দোলনের ক্রেডিট ছিনতাইয়ের চেষ্টা, আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের হলে জিম্মি করে মারধর, আন্দোলনের শীর্ষ নেতা নুরুলহক নুরুর ওপর দিনে দুপুরে বর্বর মারধর, ফারুককে মারধর করে তুলে নিয়ে গিয়ে থানায় ফেলে আসা, মশিউরকে তুলে নিয়ে গিয়ে হাতে ককটেল ধরিয়ে দিয়ে ভিডিও গ্রহণ, রাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা তরিকুলের ওপর বর্বর হাতুড়ি হামলা, শহীদ মিনারে ছাত্রীদের মারধর, বস্ত্রহরণ ও যৌনহয়রানি, শিক্ষকদের ওপর হামলা, গালি-গালাজ, লাঞ্ছনা – এভাবে লিখতে শুরু করলে এবং বিস্তারিত ঘটনার বিবরণ লিখতে গেলে বড় বড় অভিসন্দর্ভ লিখে ফেলা সম্ভব। কিন্তু কেন এতটা বেপরোয়া ছাত্রলীগ তার সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে।
৪.
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গিয়েছিলেন কুষ্টিয়ায়। না, বেড়াতে যাননি। তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেছে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়া মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়ায় যান মামলার নিয়মিত হাজিরা দিতে। কিন্তু একি! আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের পরই তিনি বুঝতে পারেন যে, পুরো আদালত এলাকা ছাত্রলীগ-যুবলীগ ঘিরে ফেলেছে। উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য তো পাগলেও বুঝে। তারা মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা করতে চায়। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তাদের যে অভিযোগ ছিল তা তো তারা আদালতে দায়ের করেই ফেলেছে! তাহলে কেন হামলা করতে চায়? এ প্রশ্নের মূলত সঠিক কোন জবাব নেই।
সে যাইহোক। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা হলো আদালত চত্বরে ক্যামেরা নিয়েও প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সাংবাদিকরা সংবাদ ও সংবাদ সংশ্লিষ্ট ছবি সংগ্রহ করে থাকেন আদালতের বাইরে থেকে। সেখানে লাঠিসোটা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রায় ৪ ঘন্টা ছাত্রলীগ অবস্থান করলো কি করে? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কর্তা ও সদস্যরাই দিতে পারবেন। শুনেছি ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দিতে মহাক্ষমতাধর পুলিশের ওসিকে তলব করে সময়মত পাননি।
সে প্রসঙ্গে কথা বলে আজ অন্তত পাঠকের সময় ক্ষেপন করতে চাই না। শুধু এতটুকু বলতে চাই ছাত্রলীগ কি দেশের আইন আদালতের উর্দ্ধে উঠে যাওয়া কোন সংগঠন? কথিত এই ছাত্র সংগঠনের আসলে কাজটা কি? গুন্ডামি, ষন্ডামি, হামলা-ভাংচুর, দখলবাজিই কি এদের দলীয় কর্মসূচী? যদি তাই না হয় তাহলে এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতিকে কি বার্তা দেয়া হচ্ছে? রাজনীতির ময়দানে পেশীশক্তি প্রয়োগ করতে করতে ছাত্রলীগ যে একটি দানবে পরিণত হচ্ছে তা কি তারা বুঝতে পারছেন? যদি বুঝে শুনেই এসব করা হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে-বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রলীগের ভবিষ্যত বলে কিছুই নেই। জুলুমের শিকার তরুণ প্রজন্মকে ছাত্রলীগ প্রতিনিয়ত যে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে তাতে বুঝাই যাচ্ছে ছাত্রলীগ রাজনীতির নামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম রাখতে চায়। কিন্তু তা কতদিন তারা কায়েম রাখতে পারবে তা নির্ভর করবে তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদে গর্জে ওঠা পর্যন্ত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট