মিরাজ খন্দকার
রাত তখন ১১ টা বেজে ১০ কি ১২ মিনিট। কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর পাওয়ার জন্য ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করছিলাম আর পাশাপাশি টিভিও দেখছিলাম। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মত আমিও মেইন স্ট্রিম নিউজ মিডিয়াকে এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। তাই তাদের নিউজগুলো থেকে সঠিক নিউজ পাওয়ার আশাও করি না। অতএব সোশ্যাল মিডিয়াই ভরসা। সেখানেও চলে গুজব আর ফেব্রিকেটেড নিউজের ছড়াছড়ি।
ফেসবুকে তখন ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢাবিতে প্রবেশের ভিডিওটি ভাইরাল। আমি ভিডিওটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি এমন সময় বাসায় নিচের গলিতে স্লোগান উঠেছে। জয় বাংলার স্লোগান। আমি ভিডিও রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম ছাত্রলীগের জনা বিশেক ক্যাডার হাতে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মিছিল করছে। নিচে দারোয়ান মারফত খবর নিয়ে জানলাম তারা যাচ্ছে ঢাকা ভার্সিটিতে। সেখানে নাকি রাজাকারের বাচ্চারা সমবেত হয়েছে। উচিত শিক্ষা দিতে হবে।
কী অসভ্য জগতে প্রবেশ করেছে দেশ! ঢাবির আন্দোলনরত ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি। এমন সময় আরেকটি ভাইরাল ভিডিও আমার দৃষ্টিগোচর হলো। এটি ছিল একসময়ের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর। তিনি সংসদে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা আখ্যা দিয়ে তিনি তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিলেন।
এদিকে ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি নাজমুল, ছাত্র মৈত্রির বাপ্পাদিত্য বসুসহ ছাত্রলীগের বহু নেতা একের পর এক হুমকি দিচ্ছিলেন আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দেয়ার। উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ খবর করলাম বন্ধু সাংবাদিকদের কাছ থেকে। জানলাম মল চত্ত্বরসহ অনেক স্থানে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ। সেখানে পুলিশও আছে। তবে পুলিশ তাদের সমস্ত মারণাস্ত্র তাক করে আছে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দিকে।
এই খবর নিতে নিতেই দেখলাম টিভিতে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে সাংবাদিকরা নাকি একজোট হয়ে কোটা সংস্কারের কোন খবর সংগ্রহ ও প্রচার করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন? কি কারণে? কিছুক্ষণ পর তাও জানতে পারলাম। আন্দোলনকারীরা নাকি তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। ঠোঁটের কোনায় বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো আর মনের অজান্তেই বেরিয়ে এলো ‘দালাল’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মুজিব সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ যখন সারাদেশের জনগণকে বিষিয়ে তুলেছিল তখনও এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। শেখ মুজিবের সরকার প্রথমে মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। পরে শেখ মুজিব এই নিয়ন্ত্রণেও খুশি থাকতে পারেননি। চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকী সব নিষিদ্ধ করে দেন।
কিন্তু বর্তমানে এমন নিয়ন্ত্রণ করেন না শেখ হাসিনা, তিনি একটু ইঙ্গিত দেন তার নেতাদের মাধ্যমে। ব্যাস এতেই কাজ হয়ে যায়। সংবাদিক নামের লোকেরা নিজেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন।
শেখ মুজিবের সরকারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পন্থা বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণের চাইতে আরো ভয়ংকর ছিল। সে সময় ছাত্রলীগকে বিশ্বাস করতে পারেননি শেখ মুজিব। কারণ ছাত্রলীগ ভেঙ্গেই বাংলাদেশের প্রথম বিরোধীদল জাসদের জন্ম হয়েছে। আর এই জাসদ শেখ মুজিবকে ভুগিয়েছেও বেশ।
জাসদসহ সকল জনগণের সকল আন্দোলন দমন করার জন্য শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। তাদের কাজ ছিল যখন যেখানে যে কোন কিছুর দাবীতে আন্দোলন করবে জনগণ সেখানে গিয়ে তাদের মাথা ফাটিয়ে দেয়া। রক্ষীবাহিনী সেই কাজ করেছে বেশ দক্ষতার সাথেই। জাসদের হাজার হাজার কর্মীকে খুন করেছে তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। যেদিন সেনাবাহিনীর একটা অংশ শেখ মুজিবকে হত্যা করে সেদিন রক্ষীবাহিনী কেবল পালিয়েছে। সেই থেকে রক্ষীবাহিনী হাওয়া। যদিও রক্ষীবাহিনীর প্রধান তোফায়েল আজো আছেন নিধিরাম সর্দার হয়ে।
অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারও একইরকম ভুল পথে এগোচ্ছে। ছাত্রদের যোক্তিক দাবীর বিরুদ্ধে তিনি ছাত্রলীগকে দাঁড় করিয়েছেন। ইতিমধ্যে খবর এসেছে কয়েকজন ঢাবির কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা পদত্যাগ করেছেন ছাত্রলীগের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য। ঢাবিতে গতকাল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারি একসাথে সাধারণ ছাত্রদের ধাওয়া খেয়েছেন। এভাবে যদি ছাত্রদের সংগঠন ছাত্রলীগকে ছাত্রদের বিরুদ্ধেই দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় তাহলে ছাত্রলীগও রক্ষীবাহিনীর মত হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে।
এই কলাম যখন লিখছি তখন খবর পেলাম গত রাতে হলগুলোতে গিয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের ভয় দেখিয়েছে। আন্দোলনে নামলে খবর করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। অনেক আন্দোলনের সংগঠকদের ধরে ধরে পিটিয়েছে। অনেককে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। সারারাত ধরে পুরো ঢাবি ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
কোটা সংস্কারের যে দাবী নিয়ে সারাদেশের ছাত্ররা আজ আন্দোলনে নেমেছে। সে দাবি বাস্তবায়িত হলে এই ছাত্রলীগের ছেলেরাই উপকৃত হবে। কিন্তু এই কথা তাদের কে বোঝাবে? তারা তো অন্ধ হয়ে আছে ক্ষমতার মোহে। শুধু ঢাবিতে নয় সারা দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগ। এরা নাকি ছাত্র সংগঠন! ছাত্রসংগঠন হলে ছাত্রলীগেরই উচিত ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া।
কিন্তু পথ হারিয়েছে ছাত্রলীগ। আর সেটা বহু আগেই। এখন তারা শুধুই শেখ হাসিনার রক্ষীবাহিনী।