অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
গণমাধ্যম হলো রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ। আর এই গণমাধ্যমকর্মীদেরকে বলা হয় জাতির বিবেক। সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজ ও দেশের সুন্দর অবকাঠামো তৈরি করা। মানুষকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। কোনো ব্যক্তি বা দলের গঠনমূলক সমালোচনা করে তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট না করা। কিন্তু, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম আজ সবই করছে উল্টো। যার সর্বশেষ নজির হলো রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনজীবী রথীশ হত্যার ঘটনা। আইনজীবী রথীশ তার স্ত্রীর পরকিয়ার বলি হয়ে খুন হলেও কিছু সংবাদ মাধ্যম ওই কথিত প্রেমিককে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
র্যাব-পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, নিখোঁজের একদিন আগেই স্ত্রী দীপা ভৌমিক ও তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম মাস্টার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আইনজীবী রথীশকে হত্যা করে। এরপর ওই লাশ ৩০ মার্চ শুক্রবার সকালের মধ্যেই গুম করে রাখেন তারা।
জানা গেছে, হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে স্নিগ্ধা সরকার দীপা এবং ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক পদে কামরুল ইসলাম একইসাথে যোগদান করেন। আর নিয়োগ দুটি দিয়েছিলেন সেই সময়ে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি পদে থাকা অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। ওই দিন থেকেই শিক্ষক হিসেবে একে অপরকে জানাশুনার সুযোগ হয় দীপা ভৌমিক ও কামরুল ইসলামের মধ্যে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের বিবাহের পর থেকেই পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। স্বামী-সংসারের প্রতি অমনোযোগী দীপা ভৌমিক পরপুরুষের প্রতি বেশি আসক্ত ছিলেন। তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই কামরুলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দীপা ভৌমিক। শুধু কামরুলই নয় আরো বেশ কজনের সাথে পরকীয়ার সর্ম্পকে জড়িয়েছিলেন দীপা ভৌমিক।
এরমধ্যে একই স্কুলের আরেক শিক্ষক মতিয়ার রহমান এবং বাবু সোনার একান্ত সহকারী (গাড়ি চালক) মিলন মোহন্ত ছাড়াও একাধিক ব্যক্তির সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল।
কিছু গণমাধ্যম কামরুলকে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে চালিয়ে দিলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন কামরুল ইসলাম। শিক্ষক হিসেবে তাজহাট স্কুলে যোগদানের পর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ওই স্কুলের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই সময়ের সভাপতির আনুকূল্যে একজন জুনিয়র শিক্ষক হয়েও নিয়ম বহির্ভূতভাবে কামরুল ইসলাম বিভিন্ন পদ পদবি পান এবং নিয়োগসহ আর্থিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে অনিয়ম দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তোলেন স্কুলটিতে। এক সময় জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কামরুলকে এখন গণমাধ্যম জামায়াত-শিবির বলে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করছে।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শুধু ভালো কাজের কথাই লিখতে হবে এমনটা কিন্তু না। তাদের খারাপ দিকটাও জনসম্মুখে প্রকাশ করার অধিকার সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের আছে। কিন্তু সেটা করতে হবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস কিংবা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট বা সমাজে তাদেরকে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সংবাদ লেখার অধিকার কোনো সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের নেই।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে সংবাদপত্রের লাগামহীন সংবাদ পরিবেশন। এখানে নিয়মনীতি বলতে কিছু নেই। কতিপয় সংবাদপত্র ও সাংবাদিক মনে হয় রাষ্ট্রের আইনের ঊর্ধ্বে। যা খুশি তাই লিখছে। সত্য-মিথ্যার কোনো বালাই নেই। ভিত্তিহীন সংবাদের কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি বা মানহানি হলো কিনা সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। মিথ্যা সংবাদ রচনা করে সমাজের ভালো মানুষকে আক্রমণ করতে পারলেই যেন তারা মনে শান্তি পায়।
কিন্তু নিউজের মধ্যে ইচ্ছেমত নিজের ভিউজ ঢুকানোর নীতিমালা সংবাদপত্রে নেই। ইচ্ছেমত প্রতিবেদন লিখে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করে রাজনীতিবিদদের সম্মান নষ্ট করার অধিকার রাষ্ট্র তাদেরকে দেয়নি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবিধানের ঊনচল্লিশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে।’’
এখানে শর্তহীনভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়নি। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যা খুশি তা লেখার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি। আইন মান্যকারী কোন নাগরিকের ব্যাপারে এমন কিছু লেখা যাবে না যা তার সম্মান বা মর্যাদা নষ্ট করে।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য ২১টি আচরণ বিধি প্রণয়ন করেছে। যেগুলো অনুসরণ করা প্রত্যেক সাংবাদিকের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
এগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো- ১। সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সত্যতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে। ২। যে সকল সংবাদের বিষয়বস্তু অসাধু এবং ভিত্তিহীন অথবা যেগুলোর প্রকাশনায় বিশ্বস্ততা ভঙ্গের প্রয়াস জড়িত সে সকল সংবাদ বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। ৩। পাঠককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোন ঘটনাকে বিকৃত করা যাবে না। ৪। ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায় বিশেষ সম্পর্কে তাদের বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, ধর্ম অথবা দেশগত বিষয় নিয়ে অবজ্ঞা বা মর্যাদাহানিকর বিষয় প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
দেখা গেছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক আজ এই সকল আচরণ বিধি বা নিয়মনীতির ধারে-কাছেও নেই। তাদের কাছে কিসের সত্য আর কিসের তথ্য। বাস্তবতার সাথে মিল না থাকলেও তারা টেবিলে বসে যা লিখবে তাই সত্য। তাদের কাছে এখন অসত্য বা ভিত্তিহীন বলে কিছু নেই। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো এখন সমাজ গঠনের চেয়ে ভাঙ্গার কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা লাগানোর চেষ্টা করছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস হলো আল্লাহর প্রতি। আল্লাহর হুকুম যারা মেনে চলার চেষ্টা করে, সংবাদপত্রগুলো তাদেরকে আখ্যায়িত করছে জঙ্গি আর সন্ত্রাসী হিসেবে। কোরআন-হাদীসের বইগুলোকে জিহাদী বই বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অহরহ বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করে দেশের আলেম-ওলামা ও রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করে যাচ্ছে। যা রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রেস কাউন্সিলের প্রণীত আইনের লঙ্ঘন।