বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর রাজধানীতে ৪ বার (২২ ফেব্রুয়ারি, ১২ মার্চ, ১৯ মার্চ ও ২৯, মার্চ) জনসভা করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ৩৪ দিনে বিএনপির করা প্রত্যেকটি আবেদনই প্রত্যাখ্যান করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্ট ভালো নয়, এ কারণে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
ডিএমপির উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে জননিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কায় জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়নি বিএনপিকে। তবে আগামী ৩০ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আলোচনা সভার যে আবেদন করা হয়েছিল তার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
১৯৭৬ সালের ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স এর ২৯ ও ৩০ ধারায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে পুলিশ কমিশনারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্ডিন্যান্সের পঞ্চম অধ্যায়ের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পুলিশ কমিশনার লিখিত আদেশ দ্বারা, যেকোনও সময় সমাবেশ বা মিছিল নিষিদ্ধ করতে পারেন। তার এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জনসাধারণের শান্তি বা নিরাপত্তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে। তবে শর্ত থাকে যে, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত তফসিল ব্যতীত কোনও নিষেধাজ্ঞা ৩০ দিনের অধিক হইবে না।’
এছাড়া ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পুলিশ কমিশনার জনসাধারণকে নোটিশ দ্বারা কোনও কোনও রাস্তায় অথবা পাবলিক স্থানে জমায়েতের মধ্যে কাউকে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞাও জারি করতে পারেন।’
জানা গেছে, সমাবেশের অনুমতি চেয়ে লিখিত আবেদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিএনপির প্রতিনিধিরা ডিএমপিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন অনুমতির নিশ্চয়তা পেতে। ডিএমপি থেকে সাড়া না পেয়ে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করছেন। গত মঙ্গলবার (২৭ মার্চ) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে, এ দফায়ও তাদের সমাবেশের অনুমতি মেলেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘সমাবেশের সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব ডিএমপির।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার রাজধানীতে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। ওই সমাবেশ তারিখের ৪ দিন আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি সমাবেশর অনুমতি নিতে ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন দলটির প্রতিনিধিরা। তখন ডিএমপির পক্ষ থেকে সমাবেশের অনুমতি দিতে আইনের কিছু বাধ্যবাধকতা কথা বলা হয়েছিল। এরপর একই দাবিতে গত ১২ ও ১৯ মার্চ জনসভা করতে চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে একই ধরনের বক্তব্য আসে।
সর্বশেষ আগামীকালের (বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ) সমাবেশের অনুমতিও পায়নি বিএনপি। বুধবার (২৮ মার্চ) বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে সমাবেশ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকালই (মঙ্গলবার) বলেছেন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জনসভার অনুমতি দেবে পুলিশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা প্রমাণিত দেশ চালাচ্ছে পুলিশ। আওয়ামী লীগ ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে বলেই দেশটা এখন পুলিশের কবজায়।’
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলছেন, ‘খালেদা জিয়াকে আগামী নির্বাচন থেকে মাইনাস করতে জাল নথি তৈরির মাধ্যমে অসত্য মামলায় প্রতিহিংসার বিচারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এ জন্য বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তা না হলে সোহরাওয়ার্দীতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ছোট ছোট দলগুলো সমাবেশ করার অনুমতি পায় শুধু বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।’
গত ২৬ মার্চের এক আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এত নির্যাতন-হত্যার পরও আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পেলে সেই নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই। কিন্তু সেই মুহূর্তে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা জন্য। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় জেলে নিয়ে বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করছে সরকার।’
বিএনপির নেতাদের ভাষ্য, ‘সরকারের ভয়, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রাস্তায় বড় কোনও আন্দোলন হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। কারণ গত বছর খালেদা জিয়া বছর লন্ডন সফরের পর কক্সবাজার সফর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমাবেশে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি, সিলেট সফরে ব্যাপক সাড়া পড়ায় তারা আতঙ্কিত। তাই বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না আওয়ামী লীগ।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার সবসময় বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামকে ভয় পায়। তারা আমাদের জনসমর্থন সহ্য করতে না পেরে দমন-নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করছে। এর আগে বিএনপির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লোক সমাগম থেকে ভয় পেয়েছে। এই কারণে এবার সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। সেই নীলনকশা বাস্তবায়ন করতে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।’
এদিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি সমাবেশ করতে না পারলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। গত ৩ মার্চ সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ, ২৪ মার্চ জাতীয় পার্টি সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করেছে। এছাড়া সরকার সমর্থিত কয়েকটি ইসলামিক দলও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে। যেখানে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সমাবেশের অনুমতি তো আর আওয়ামী লীগ দেয় না, এটা দিয়ে থাকে ডিএমপি। তাই বিএনপিকে কেন সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না তা ডিএমপিই বলতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিএমপি তার নিয়ম অনুযায়ী যাদের উপযুক্ত মনে হচ্ছে তাদের সমাবেশ করা অনুমতি দিচ্ছে। এখানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনও সম্পর্ক নেই।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন