রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বাড়ছেই। আর ব্যাংকগুলোর এই ঘাটতি পূরণের জন্য দেদার টাকা দিয়ে যাচ্ছে সরকারও। এবার এসব ব্যাংককে দুই হাজার কোটি টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কাছে সুপারিশ করেছে একই মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী সোনালী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক এবং বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতকাল মঙ্গলবারের হিসাব বলছে, ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে এখন ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা হয়েছে। তিন মাসের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সোনালী ব্যাংকের কারণেই মূলত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের সার্বিক মূলধন ঘাটতি অনেক বেড়েছে। তিন মাসে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে যেখানে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, সেখানে ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ গতকাল মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মূলধন ঘাটতি বাড়েনি, ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকাই আছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতকালের তথ্য উল্লেখ করে তিন মাসে মূলধন ঘাটতি দ্বিগুণ হওয়ার প্রসঙ্গ তুললে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে আবারও টাকা পাচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। ছয় ব্যাংক এবার পেতে পারে দুই হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের শেষে অর্থাৎ মে-জুন মাসের দিকে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ব্যাংকগুলোকে দেওয়ার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে অবশ্য ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ খাতে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে।
ছয় ব্যাংককে দুই হাজার কোটি টাকা ভাগ করে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কাছে চাহিদাসংবলিত একটি সুপারিশপত্র পাঠিয়েছে একই মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
কখনো মূলধন ঘাটতি বা প্রভিশন ঘাটতি পূরণের নামে, কখনোবা মূলধন পুনর্গঠন বা মূলধন পুনর্ভরণের নামে ছয় ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংককে আগে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদে জানান, ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকার ১০ হাজার ২৭২ কোটি টাকার পুনর্মূলধনীকরণ সুবিধা দিয়েছে।
এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এবারের সুপারিশকে আপাতত গ্রহণযোগ্য মনে করছে না অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হলেও ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো তো হচ্ছেই না, বরং দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এভাবে জনগণের টাকা ব্যাংকগুলোকে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
জানতে চাইলে অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে একবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে একটা চাহিদাপত্র এসেছিল, কিন্তু আমরা টাকা দিতে চাইনি।’ বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে বলে জানান অর্থসচিব।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চাহিদাপত্রে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মূলধন ঘাটতি পূরণে সোনালী, জনতা ও কৃষি ব্যাংকের জন্য ৪০০ কোটি টাকা করে মোট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের জন্য চাওয়া হয়েছে ৩০০ কোটি করে মোট ৬০০ কোটি। এ ছাড়া রাকাবের জন্য ২০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
এদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা ছাড় হয় সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে। এবারও তা-ই হবে।’
মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেটে টাকা রাখার চর্চাটি শুরু হয় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংক খাতে বড় কেলেঙ্কারিগুলোও শুরু হয় ওই বছর থেকে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর জন্য যত টাকা বাজেটে রাখা হচ্ছে, সে তুলনায় মূলধন ঘাটতি পূরণের চাহিদা তাদের ১০ গুণ বেশি।
বিকল্প উপায় বাদ!
অর্থ বিভাগ এখন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে টাকা বরাদ্দ রাখতে নারাজ। এর আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে বিকল্প উপায় বেরও করেছিল, কিন্তু কার্যকর করতে না পেরে সহজ উপায় অর্থাৎ নগদ টাকা দিয়ে দেওয়ার পথই নিচ্ছে এ বিভাগ।
মূলধন ঘাটতি পূরণে বেসিক, জনতা ও রূপালী ব্যাংক গত বছর যখন বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নেয়, বাংলাদেশ ব্যাংক তখন মূলধন ঘাটতি পূরণের চার সম্ভাব্য উপায় এবং এর সুবিধা-অসুবিধা চিহ্নিত করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গুরুত্ব দিয়ে সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণও করে। উপায়গুলো হচ্ছে সরাসরি নগদ মূলধন সরবরাহ, বন্ড ছাড়া, বোনাস শেয়ার ছাড়া এবং খেলাপি ঋণ কমানো।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনমতে, সরাসরি মূলধন সরবরাহ একটি ভালো উপায় হলেও বাজেটে মূলধন পুনর্গঠন খাতে যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, ব্যাংকগুলোর এ–সংক্রান্ত চাহিদা তথা ঘাটতির তুলনায় তা খুবই কম। আবার বন্ড ছাড়লে আপাতত সরকারের কোনো আর্থিক দায় তৈরি না হলেও মেয়াদ শেষে বন্ড সুদাসলে ক্রেতাদের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে ওই দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতে, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপায় নিট মুনাফা অর্জন করে তা বণ্টনের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার ছাড়া। এ বিভাগই আবার বলছে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মুনাফা অর্জনের ধারায় না থাকায় এ উপায় বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ কম। বিভাগটির মতে, আরেকটি ভালো উপায় হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি কমানো। কিন্তু এ ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই ব্যাংকগুলোর।
ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তাই আরেকটি বৈঠক করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বৈঠক শেষে সচিব ইউনুসুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বর্তমানে সরকারের যেসব সেবা বিনা মূল্যে দিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো, সেগুলোর বিপরীতে মাশুল নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। এ জন্য আগামী বাজেটে একটি তহবিল গঠন করা হতে পারে।
সূত্র: প্রথম আলো